অভিমত

এসএমই মেলা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন

ফেরদাউস আরা বেগম

প্রায় ১০ বছর ধরে এসএমই ফাউন্ডেশন সপ্তাহব্যাপী এসএমই মেলার আয়োজন করে আসছে। কভিডকালীন আয়োজন সম্ভব না হলেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নবম মেলার আয়োজন করা হয়েছে -১২ ডিসেম্বর। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। প্রায় ৩০০ উদ্যোক্তা এতে অংশ নেন, যার ৬২ শতাংশের বেশি নারী। ২০১২ সালে স্টলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫। এখন স্টলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বর্তমানে বিক্রয় অর্ডারের পরিমাণ যথেষ্ট বেড়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মেলায় ২০২০ সাল থেকে প্রতিবন্ধী তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তারাও অংশ নিতে পারছেন; যা অত্যন্ত আনন্দের। এছাড়া নৃগোষ্ঠী প্রান্তিক উদ্যোক্তারা এতে অংশ নিয়েছেন। এদিক থেকে মেলাকে সর্বজনীন বলা যায়।

এসএমই উদ্যোক্তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন মেলার জন্য। কারণ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মেলায় অংশ নেন। এটা এমন একটি মেলা, যা একদিকে উদ্যোক্তার পণ্য বিক্রিতে সহায়ক, অন্যদিকে একই সঙ্গে অন্যের পণ্য দেখে নিজের পণ্যের মান বোঝার, ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, বৃহৎ পরিসরে পণ্য বিক্রির অভিজ্ঞতা লাভে বিশেষভাবে সহায়তা করে। তাই মেলার উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রসার, প্রচার এবং স্থানীয় পর্যায়ে বাজার সম্প্রসারণ, পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সেতুবন্ধ, উদ্যোক্তা ভোক্তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, সব মহলের মতামত গ্রহণ, যাতে খাতের উপর্যুপরি প্রসার ঘটে। একটি বড় বিষয় হলো, এখানে বিদেশী-আমদানীকৃত পণ্যের প্রদর্শন বা বিক্রির কোনো সুযোগ থাকে না। তাই সপ্তাহব্যাপী মেলা অনেকটা নিজের দেশের কৃষ্টি, কালচার, শিল্পী, উদ্যোক্তাদের চেনা জানার একটা সুযোগ করে দেয়।

তবে বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ উদ্যোক্তা এতটাই ক্ষুদ্র যে তারা নিজের দোকান-স্টল সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন। এখানে উদ্যোক্তা নিজেই দোকান সামলান, দাম নির্ধারণে এমনকি দর কষাকষিতে অংশ নেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা অনেকটা কে কার পণ্য বেশি বিক্রি করতে পারবেন, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই অন্যের পণ্য কী ধরনের, তা থেকে নতুন কী নেয়া যায়, সে ব্যাপারে খুব একটা তত্পরতা দেখা যায় না।

পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে তেমন একটা বৈচিত্র্য এবারের মেলায় দেখা যায়নি। বেশির ভাগই বুটিক-বাটিকের তৈরি পোশাক, শাড়ি, গহনা প্রাধান্য পেয়েছে। প্রায় একই ধরনের হাতের কাজ, নকশিকাঁথা, পাটপণ্য, বাটিক, চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি স্টলের প্রধান আকর্ষণ ছিল। এর মধ্যে ক্লথিং ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। এর পরে রয়েছে হস্তশিল্প, চামড়াজাত পণ্য, পাট পাটজাত পণ্য ইত্যাদি। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, গৃহসজ্জা, নার্সারি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ফ্যাশনওয়্যার, সিরামিকস, মাটির পণ্য ইত্যাদিও প্রদর্শন করা হয়। এখানে এগুলোকে এসএমই বলা হলেও বেশির ভাগই ছিল কুটির মাইক্রো শিল্পজাত পণ্য।

শিল্পনীতি অনুযায়ী ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ ক্ষুদ্র এবং ৫০ কোটি টাকার উদ্যোগকে মাঝারি বলা হয়। এখানে এমন কোনো বিনিয়োগ দেখা যায়নি। তাই এটাকে এসএমই মেলা না বলে কুটির ক্ষুদ্র শিল্প মেলা বলা যেতে পারত। আর মাঝারি বৃহৎ শিল্পের জন্য আলাদা মেলা হতে পারত। হয়তো মাঝারি বৃহৎ উদ্যোগ মেলার জন্য অপেক্ষা করে না, তাই তারা পণ্য বিক্রি বাড়াতে মেলার পরিবর্তে বরং বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ব্যবহার করেন এবং টিভি চ্যানেলে আমরা অহরহ এগুলো দেখি, যেখানে কুটির শিল্পজাত পণ্য কমই থাকে। এটি অবশ্যই স্বীকার্য যে অবস্থানভেদে উদ্যোক্তাদের বাজারজাত, ব্র্যান্ডিং, বিক্রি ইত্যাদির ধরন আলাদা।

ক্ষুদ্র উদ্যোগের প্রতি বরাবরই আমার আন্তরিকতা আছে, তাই প্রতিবারের মতো এবারো মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। তিনশর বেশি ক্ষুদ্র শিল্প কারিগর মেলায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে সবাই রকমারি পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। কিছু  হ্যান্ড পেইন্ট সিরামিকস, সুপারি পাতার তৈজস, নকশিকাঁথা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এসব উদ্যোক্তাকে একটু সহায়তা দিতে পারলে হয়তো রফতানিতে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। এজন্য গুণগত মানের উন্নয়ন, পণ্যের বৈচিত্র্য, রঙ, ব্যবহারের উপযোগিতা, সর্বোপরি ডিজাইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পণ্য উৎপাদনের মাত্রা অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। অতীতে দেখা গেছে রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। কারণ ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সমসংখ্যক পণ্য সময়মতো তৈরি করা যায়নি। এক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক পণ্য উৎপাদন, এক পণ্য এক গ্রাম বা one village one product, One Tambon one product movement-এর কথা আমরা শুনেছি। তাদের তৈরি সুন্দর পণ্যও আমরা দেখেছি। সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে। 

এবারের মেলায় একটি বিষয় ভালো লেগেছে, তা হলো একটি আলাদা জায়গায় শুধু তৈরি মেশিনারি প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে কিছু স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত মেশিনারিও ছিল। ঢাকা জেলার ধোলাই খাল থেকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ প্রস্তুত মেরামত করে এমন কিছু ফার্ম যোগ দিয়েছিল। মেশিনঘর নামের প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ওজনের কংক্রিট মিকশ্চার মেশিন, কংক্রিট হপার মিকশ্চার, রুফ হোয়েস্ট মেশিন, ইট ভাঙার মেশিন, টাওয়ার উইঞ্চ মেশিন, ডিজেল ভাইব্রেটর, বৈদ্যুতিক মোটর ভাইব্রেটর, নজেল, লেদ মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন, কার্গো লিফট তৈরি করে তা প্রদর্শন করে, যা বেশ প্রশংসনীয়। এছাড়া ধরনের অসংখ্য ছোট মেশিন প্রস্তুতকারীর সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের প্রত্যয়ের কথা শুনে সত্যি আনন্দ লেগেছে। মেশিনারি তৈরিতে বাংলাদেশ একেবারেই পিছিয়ে। প্রায় শতভাগ মেশিনারি আমদানীকৃত। আমদানির ক্ষেত্রে আবার শুল্ক মওকুফ রয়েছে। মনে হয় খুদে উদ্যোগগুলোকে একটা ক্লাস্টারের ভিত্তিতে সুবিধা দেয়া হলে এরা হয়তো এগিয়ে যাবে। কৃষির ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে তৈরি মেশিনারির এরই মধ্যে বেশকিছু সাফল্য দেখা গেছে।

পঞ্চাশোর্ধ্ব এক শিল্পীর কাছে দেখলাম অসংখ্য মাটির পুতুল, ফুলদানি, টেবিল ল্যাম্পসহ আরো কত কী। জিজ্ঞাসা করলাম, এত সুন্দর করে আপনি এগুলো বানান, আপনার সঙ্গে কে কাজ করে? তিনি জানালেন, তার স্ত্রী কাজ করে এবং তিনি মাটির একটি নাম বললেন, যা আমি জীবনে কখনো শুনিনি। তিনি জানালেন, মাটি খুব রাগী, তাই এর সঙ্গে আরেক ধরনের মাটি, যা তিনি মিরপুর থেকে সংগ্রহ করেন, মিশিয়ে চালুনি দিয়ে চেলে নিখুঁত পেস্ট তৈরি করেন। আর তিনি এগুলো বানান পুরান ঢাকায়। যথেষ্ট সুন্দর কারুকাজের হস্তশিল্পের কারিগর নিতান্তই অবহেলিত। তাকে একটা কার্ড দেয়ার অনুরোধ করায় তিনি তা দিতে পারলেন না। পরনে মলিন সাদা ফতুয়া টাইপের একটি জামা আর লুঙ্গি, তবে সৃষ্টির আনন্দে তার মুখটি ছিল সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত। তিনি তার পণ্য বেশি বিক্রি করতে পারলেন কি পারলেন না, তা নিয়ে তেমন কোনো ক্ষোভ আছে বলে মনে হলো না। কারণ তার চাওয়া খুবই সীমিত। তবে তিনি যে নিজের হাতের তৈরি পণ্য এখানে সবাইকে দেখাতে পেরেছেন, এতেই তার আনন্দ। আমার মনে হলো, এরাই প্রকৃত শিল্পী, এদের মর্যাদা আমরা কবে দিতে পারব। মনে হলো মৃিশল্পের জন্য আমরা কিছু করতে পারি, এর সঙ্গে রঙের কারুকাজে চমত্কার দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা যায়।

আগামী ২০২৬- আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি, যখন আমাদের প্রেফারেন্সিয়াল বাজারভিত্তিক সুবিধা হ্রাস পাবে তখন আমাদের সক্ষমতা এবং তার থেকে নিজস্ব উৎপাদনভিত্তিক সক্ষমতা বেশি প্রাধান্য পাবে। আমাদের নিজস্ব সম্পদ এবং এর কারিগরদের বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। এর প্রস্তুতি এখনই শুরু করা দরকার।

সুপারি পাতার তৈজস তৈরিতে অবদান রাখছেন বেশকিছু উদ্যোক্তা। কেউ আবার এতে নতুনত্ব এনেছেন পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে। একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে এটি সহজেই বাজার দখল করে নিতে পারে যদি তাদের কারিগরি জ্ঞান বাড়ানো যায় এবং স্কেল অব প্রডাকশন বাড়াতে হলে প্রযুক্তির সহায়তা নিতেই হবে।

সিরামিকের তৈজসপত্রের ওপর হ্যান্ড পেইন্ট করেছেন একজন উদ্যোক্তা, এত চমত্কার রঙের কারুকাজ, দেদার বিক্রি হচ্ছে, বিক্রেতা পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিতে হিমশিম। তরুণ এসব নারী উদ্যোগ বহুদূর যেতে পারবে বলে মনে হয়। তবে এখানে স্বল্প মূল্যে আমদানীকৃত চীনা পণ্য বিপুলভাবে জায়গা করে নিয়েছে। খাতকে সহযোগিতা বিশেষভাবে দরকার।

ভালো-মন্দ মিলিয়ে মেলাটি ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য যথেষ্ট সহায়ক। এখানে আরো বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে। কীভাবে বাজারজাত করতে হবে, স্টলে পণ্য ডিসপ্লে করা হবে, ডিজাইন, রঙ, প্যাকিং ইত্যাদি বিষয় রয়েছে; যা ক্রেতাকে আকর্ষণ করতে পারে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মহতী প্রচেষ্টার পেছনে ব্যাপক গবেষণার দরকার রয়েছে, যাতে ক্রেতা হতাশ না হন। নিট অ্যাসেসমেন্ট আরেকটি বড় প্রয়োজন। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আপসোস করেছেন যে তারা অর্থায়নের অভাবে ব্যবসা বড় করতে পারছেন না। তাদের যে সময়ে অর্থের দরকার, সে সময়ে তা তারা পাচ্ছেন না। কাঁচামাল, ডিজাইন, পণ্য নকল হয়ে গেলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যাবে সে ব্যাপারে ধারণা নেই। এছাড়া সরকার যেসব সুবিধা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের দিচ্ছে, তার তথ্য তাদের কাছে নেই। আর এগুলো পেতে যেসব দলিলের প্রয়োজন, ব্যাপারেও তারা সেভাবে অবগত নন।

সরকার ক্ষুদ্র উদ্যোগ, বিশেষ করে নারী উদ্যোগ সামনে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন টার্গেট ঘোষণা করেছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন টার্গেট রয়েছে, যা পূরণ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে যারা অর্থের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা তা পাচ্ছেন না। কারণ অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান তাকে ঋণ প্রদানে ভরসা করতে পারছে না। গ্যাপ কী করে পূরণ করা যায়, এজন্য প্রচুর কাজ করা দরকার এবং পলিসি অ্যাডভোকেসি প্রয়োজন। আমরা আশা করতে চাই ক্ষুদ্র উদ্যোগের সদিচ্ছা আমরা ধরে রেখে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারব, যাতে তারা আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেন এবং জিডিপিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি পান। 

 

ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন