ডোন্ট লুক আপ: চলতি পৃথিবীর চেনা গল্প, তবে...

রুহিনা ফেরদৌস

ডোন্ট লুক আপ ছবির একটি দৃশ্য

পৃথিবীর দিকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে বিশালাকার ধূমকেতু। মাত্র কয়েক মাস সময় আছে গ্রহটির মানুষের হাতে। এ সহজ কথাই অসহায় দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিন্ডি (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও) আর কেট (জেনিফার লরেন্স) ক্ষমতাধর মানুষগুলোকে বোঝাতে মরিয়া। প্রথমে তারা খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে যান। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রের অন্য দশটা সমস্যার মতোই মামুলি (!) বিষয় হিসেবে তা বিবেচনা করেন। তার মাথাব্যথা সামনে থাকা সিনেট নির্বাচন ঘিরে। একটা সময় সংবাদমাধ্যম আর টিভি চ্যানেলের দ্বারস্থ হন তারা। উদ্দেশ্য, ভয়াবহ বার্তাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু টকশো উপস্থাপকের আসনে যারা বসে আছেন তারা ব্যস্ত চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে। দুই বিজ্ঞানীর কথা সেখানে তেমন গুরুত্ব পায় না; বরং ধূমকেতু আঘাত হানার বিষয়টি নিয়ে যখন উপস্থাপকরা হাস্যরসে মেতে ওঠেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেট তখন রেগে গিয়ে চিত্কার করে বিষয়টি বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। রীতিমতো ভাইরালে পরিণত হয় সে ঘটনা। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্যনতুন ট্রল শুরু হয়। ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে সবাই।

ধূমকেতু আঘাত হানার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মার্কিন মিডিয়া, সেখানের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির হর্তাকর্তারা কীভাবে নিজেদের স্বার্থ খুঁজতে ব্যস্ত এবং কীভাবে তারা নিজেদের নাগরিকসহ সারা দুনিয়ার মানুষকে অন্ধ করে রাখছে তার সেন্সরবিহীন উপস্থাপন ডোন্ট লুক আপ

সময়টা চোখ বন্ধ করে ছুটতে থাকার। ডান-বাম, উপর-নিচ, চারপাশকোনো দিকেই না তাকানোর; এমন সব মন্ত্র শেখানো হচ্ছে রোজ মানুষকে। কিন্তু কেন? কারণ চোখ তুলে তাকালেই তো বিপদ। যদি চারপাশের মসৃণ মিথ্যার পর্দাগুলো সরে যায়? আড়ালের সত্যিটা ফুটে ওঠে? মুখোশ খুলে যায় ক্ষমতার পেছনে থাকা মানুষগুলোর? বাণিজ্য আর পুঁজিই যাদের একমাত্র লক্ষ্য, যারা পৃথিবীর মানুষের ভয়াবহতম বিপদের দিনেও লাভের ছক আঁকে; তাদের এ সত্য সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করলেই ধস নামবে পুঁজির সাজানো সাম্রাজ্যে। ভয় এখানেই। তাই চোখ তুলে দেখতে মানা। 

অ্যাডাম ম্যাককে পরিচালিত নেটফ্লিক্সের ডোন্ট লুক আপ ছবিটি চোখে আঙুল দিয়ে বর্তমানের ঘুণে ধরা পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়। যেমনটা আমরা দেখি বিদ্যমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে। বিশ্বের পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন করোনার টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন পার করছে, ক্ষমতার অদৃশ্যরেখার ওপারের মানুষেরা তখন দূরভবিষ্যতের জন্য টিকা মজুদ, দরকষাকষি আর ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতি নিয়ে ব্যস্ত।

করোনার বিপর্যয় কাটেনি। ভাইরাসটি এর ধরন বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিসংখ্যান অনুসারে, ধনী রাষ্ট্রগুলোয় গড়ে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হলেও অফ্রিকার পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ নাগরিকের কাছে টিকা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত নাইজেরিয়ার মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ, ইথিওপিয়ার ১ দশমিক ৩ শতাংশ ও সুদানের ২ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে।

অথচ ধনী বিশ্বের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট টিকা মজুদ রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা এয়ারফিনিটির সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কভিড-১৯ টিকা মজুদের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫০ কোটি ডোজ। চলতি বছর শেষে তাদের কাছে প্রায় বাড়তি ১২০ কোটি টিকা মজুদ থাকবে।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, কভিড মহামারী আরো কয়েক কোটি মানুষকে নতুন করে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, নব্বইয়ের দশকে এশিয়ার আর্থিক সংকট-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২০ সালে। কভিডের সঙ্গে বাড়ছে বৈষম্য, রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; যা দারিদ্র্যের শিকার মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়িয়ে তুলছে।

ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে যে পৃথিবীর সব নাগরিকের এখনো করোনার টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই, যে পৃথিবীতে শত শত মানুষ প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, সে পৃথিবীর নেতারা আজও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার প্রসঙ্গে একমত হতে পারছেন না। ডোন্ট লুক আপ ছবিতে যেমন আমরা দেখি ধূমকেতুর আঘাতে প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতির বিপরীতে আসন্ন সিনেট নির্বাচনে এ ইস্যুটিকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে বিপক্ষ দলকে পরাস্ত করা যায় তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া কপ২৬ সম্মেলনে প্রত্যাশা অনুসারে প্রাপ্তি সংখ্যা যেমন শূন্যের ঘরে।

অথচ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির কর্তা ব্যবসায়ীরা মহাকাশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা ওই ছবির কথা নয়, বাস্তবের। কার আগে কে যাবেন তা নিয়ে তাদের শীতল প্রতিযোগিতা। বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তবান জেফ বেজোস মাত্র ৪ মিনিট সময় মহাকাশে কাটানোর জন্য খরচ করেছেন ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিজনেস ম্যাগনেট রিচার্ড ব্রানসন ও ইলোন মাস্কও তাদের মহাকাশ ভ্রমণের পাট চুকিয়ে এসেছেন লাখ লাখ ডলার খরচ করে।

অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকস একটি হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ধনী বিশ্ব যদি বার্ষিক ১৭৫ বিলিয়ন ডলার করে সহায়তা দেয়, যা দেশগুলোর সম্মিলিত আয়ের ১ শতাংশেরও কম, তাহলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বিশ্ব থেকে চরম দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব হবে। যদিও প্রতি বছর আমেরিকার জাতীয় প্রতিরক্ষা বাজেট বাবদ বরাদ্দ থাকে ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের প্রায় চার গুণ বেশি অর্থ।

ডোন্ট লুক আপ ছবির ধেয়ে আসা ওই ধূমকেতু যেন আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। করোনা মহামারী কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের রূপক উপস্থিতি। ছবির মানুষগুলোর মতো আমরাও ভীষণ নির্লিপ্ত। তা না হলে কপ২৬ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সে-বিষয়ক মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন না কিংবা সম্মলন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত প্রতিশ্রুতিগুলো রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে রীতিমতো ভুলে যান। ছবিতে যেমনটা প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে দেখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট চরিত্রে অভিনয় করা মেরিল স্ট্রিপ আর প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার পিটার, অর্থাত্ মার্ক রেলান্সকে। প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার চরিত্রে মার্ক রেলান্সের টেনে টেনে কথা বলা আর একঘেয়ে উপস্থিতি (চরিত্রের প্রয়োজনে) মনে রাখার মতো।

চলতি পৃথিবীর চেনা গল্প ডোন্ট লুক আপ। বর্তমান সময়ের মানুষ উন্নয়ন আর উদযাপনের যে রোগে ভুগছে, তার তীব্র উপস্থিতি এ ছবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যা আমাদের কলহ-মীমাংসার ভার্চুয়াল জমিন, এ জমিন থেকে চোখ ফিরিয়ে সত্যিকারের পৃথিবীর দিকে তাকাতে মানা আমাদের। যে পৃথিবীর একটি অংশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত; যে পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো হয়েছে সম্পদ, সমৃদ্ধি, শঠতাই মোদ্দাকথা; যে পৃথিবীর একটি অংশের নেতারা মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে কিছু নেই। জোহান হিল, কেট ব্ল্যানচেট, টেইলার পেরিসহ একঝাঁক তারকা শিল্পীর অংশগ্রহণে ডোন্ট লুক আপ তাই এ বছরের সেরা স্যাটেয়ার; যা ধনী পুঁজিবাদী বিশ্ব আর জায়ান্ট করপোরেটদের উলঙ্গ উপস্থাপনই নয়, বরং তাদের ওপরে না তাকানো তত্ত্ব পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে তা তুলে ধরে এবং আমাদের উদ্দেশে অন্ধকার এক বার্তা ছুড়ে দেয়।
লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন