মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে

ড. শ্রীরাধা দত্ত 

দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। দায়িত্ব পালন করছেন নিউ দিল্লিভিত্তিক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো হিসেবে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অধীন ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। পরিচালক ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজের। পিএইচডি করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সংযোগ নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্ণ হয়েছে। সম্পর্কের অনেক উত্থান-পতন লক্ষ্য করা গেছে। কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন সময়টাকে?

অসম্ভব একটি ঐতিহাসিক সংযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের যাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের বড় সহযোগিতা ছিল। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম কয়েক বছর শেখ মুজিবুর রহমান ও মিসেস গান্ধী যখন ছিলেন, দুই তরফের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবে কিছু কাজ হয়েছে। তারপর জিয়াউর রহমান, পরবর্তী সময়ে এরশাদের শাসনামলে দুই দেশ অন্যরকম সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। সম্পর্ক একেবারে চ্যুত হয়ে গেছে সেটা বলব না। কিন্তু যে ঘনিষ্ঠভাবে আমরা প্রথম কয়েকটা বছর কাজ করেছিলাম, সার্বিকভাবে সেটা একটু স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু হলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে কাজ শুরু হয়। কিন্তু ৫০ বছর পর এ সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, ঢাকায় যখন আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো সরকার থাকে, সম্পর্কটা তখন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এমন না যে কাজ হয় না। কথা চলে, নানা ধরনের সংলাপ চলে, অনেক কথা এগোনো যায়। ধরুন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার এলে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আরো কিছু কাজ হয়েছিল সিএসটি নিয়ে। কিন্তু এটাও সত্য, হঠাত্ করে চুক্তিটি হয়নি। অনেক কথা চলেছে অনেক বছর ধরে। এমন না যে অন্য সরকারের সময় সেটি আটকে ছিল। তারপর আওয়ামী লীগ আসার পর মুজিব কন্যা সূত্রে একটা সম্পর্ক তো ছিলই, অস্বীকার করার উপায় নেই। সে সময়ে আমরা দেখেছি সম্পর্কটা আবার খুব সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে।

কিন্তু খুব দুঃখের জায়গা যে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল যেমনভাবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কিছু আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। আমার দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের সঙ্গেও সম্পর্কটা সে সময় সব থেকে খারাপ গিয়েছিল। একদিকে আমরা চেষ্টা করেছি এনার্জি নিয়ে কাজ করার। সংলাপ চলছিল। কিন্তু কেন যেন কিছুতেই কোনো জায়গা করে নেয়া যাচ্ছিল না।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পরিবর্তন এলো দেশে। ২০১০ সালে মধ্যে যে ফ্রেমওয়ার্ক অব কো-অপারেশন দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর হয়েছিল, সে সূত্রেই আমরা এখন এগিয়ে চলছি। আমরা এখন অনেক কাজ করেছি। যার মধ্যে সবচেয়ে চমত্কার জায়গা বাউন্ডারি ডিমার্কেশন। আমি জানি, এটা বাংলাদেশের অনেকদিনের একটা আক্ষেপ ছিল যে এটা করা হচ্ছে না। অনেক কথাও চলেছিল কিন্তু নানা কারণে আটকে ছিল। সেই কাজটা হয়েছে খুবই সুন্দরভাবে, কোথাও কোনো ভায়োলেন্স ছাড়া কথার মধ্য দিয়ে বিষয়টা এগিয়ে গেছে। তাছাড়া এখন আমরা যেটা দেখছি বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ, খুবই ঘনিষ্ঠ দুটি পক্ষ। এমন কোনো দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্র নেই যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি না। যেটা আমাদের আগে কখনো ছিল না, ডিফেন্স কো-অপারেশনে আমাদের বেশি এগোনো হয়নি, সেটাও করা হয়েছে। আমি বলব দুই দেশের ক্ষেত্রে এ সময়টা সোনালি অধ্যায়।

আমরা কেবলই দ্বিপক্ষীয় অংশীদার (বাইলেটারাল পার্টনার) নই। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমরা যেভাবে ক্রসবর্ডার কানেকটিভিটি, পরিবহন ব্যবস্থা (ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম করিডোর) তৈরি করছি, আমরা মূলত আঞ্চলিক মৈত্রী (রিজিওনালিজম) এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে এ বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমরা দুজন দুজনের সঙ্গে কাজ করে কেমন করে পুরো অঞ্চলটাকে একত্রিত করতে পারি, সেটা চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা প্রথমে চেষ্টা করছি ট্রান্সপোর্ট করিডোর দিয়ে বাণিজ্য ও অর্থায়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেখান থেকে সব দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ যেভাবে আমাদের ট্রানজিট দিয়েছে উত্তর-পূর্বাংশে পৌঁছানোর জন্য ঠিক তেমনি নেপাল ও ভুটান সহজে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য যুক্ত হতে পারছে, এটা খুব সুন্দর একটা জায়গা।

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কি দুই দেশের রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করে?

পঞ্চাশ বছরের অবস্থা যদি লক্ষ্য করে দেখেন, দিল্লিতে যে সরকারই আসে—কংগ্রেস কিংবা বিজেপি—আমরা কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করি। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই সে বিষয়টা কাজ করে। আমরা যেভাবে এগোতে পারব, আমাদের উন্নতি, অগ্রগতি প্রভৃতি কিন্তু বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে। এ বিষয়টি কিন্তু বাংলাদেশে নেই। ২০০১ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে নন-আওয়ামী সরকার যখন ছিল, আমরা যতটাই চেষ্টা করে থাকি কাজ এগোতে পারিনি। কিন্তু তারপর ২০০৯-১০ থেকে আমরা যেভাবে কাজ এগোতে পেরেছি, সেটা আশা করব আরো এগোবে। আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন।

যদি দুই দেশের মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব আমাদের মূল লক্ষ্য নিরাপত্তা। আমাদের বিদ্রোহী অংশগুলোর কথা বলুন বা নর্থ-ইস্টের অস্থিরতার কথাই বলুন, তারা এক সময়ে বাংলাদেশ থেকে সমর্থন পেত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এটি তিনি বন্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোন বিষয়টি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর ভারতবর্ষ যে ধরনের সহায়তা কাউকে কখনো করেনি, ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আমরা বাংলাদেশকে দিয়েছি। এটা একটা অন্যরকম চমত্কার জায়গা। এর বাইরে আরো যেটা বললাম নানা ধরনের প্রজেক্টের কাজ চলছে। ভারত ও জাপানের যৌথ সহায়তায় ঢাকায় ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ চলছে। সেটাও আমাদের নতুন একটা প্রচেষ্টা। দক্ষিণ এশিয়ায় এ রকম কখনো হয়নি।

বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করলে কত সুবিধা হয়। কত লোক তার সুবিধা ভোগ করে। আশা করি, আগামীতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক বিগত ১০ বছরে যে কাজগুলো শুরু হয়েছে, সেগুলো চলতে থাকবে। যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা পুরনো দৃষ্টিতে ভারতকে দেখবে না, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকাবে।

ভারতের গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়, বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত অবস্থান, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী? আর সার্ক কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না?

দুটো দিক—সার্ক নিয়েই কথা বলি প্রথমে। সার্কটা বাংলাদেশ থেকে জিয়াউর রহমানের সময় শুরু হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশীয় পরিচয় বা আঞ্চলিকতা বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেটা সার্কের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি। এখন অনেক ধরনের উপ-আঞ্চলিকতা তৈরি হচ্ছে। কিছু কাজ এগোচ্ছে বটে কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এটা পাকিস্তানকে দোষারোপ বা পাকিস্তানের দ্বারা ভারতকে দোষারোপ ধরনের কিছু না। আমাদের আগের যে সরকার বা বর্তমান মোদি সরকার, সব সময়েই পাকিস্তানের দিকে হাত বাড়িয়েছে। কারণ আমরা বুঝতে পারি এ প্রতিযোগিতামূলক সময়ে একত্রে কাজ না করলে এগোনো যায় না। এককভাবে প্রত্যেকেরই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এক সঙ্গে কাজ করে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। কিন্তু আপনারা সব সময় খেয়াল করেছেন, সন্ত্রাসকে পাকিস্তান সময় সময় ফরেন পলিসির টুল হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিছুদিন আগে অবধিও তা হয়েছে।

আমি একটু মনে করিয়ে দিতে চাই এ প্যানডেমিকের মধ্যেও প্রাইম মিনিস্টার মোদি সার্ক নেতাদের অনলাইনে ডেকেছিলেন যে প্যানডেমিকের সময় একসঙ্গে কেমন করে কাজ করব। সেখানেও সবগুলো দেশ নিজেদের মধ্যে সহায়তার কথা বললেও পাকিস্তান একটু আলাদাভাবে নিজেদের রাখতে চায়। ওখানে এখন নির্বাচিত সরকার আছে কিন্তু সেনাবাহিনী কখনই সার্ক কিংবা ভারতের সঙ্গে মিলে কাজ করতে দেয়নি বা দেয়া হচ্ছে না। সার্কের নীতি আছে যে সবাই আমরা একত্র না হলে কাজ করতে পারব না। কিন্তু সার্কের মধ্যেও সনদ অনুসারে একটা উপ-আঞ্চলিক সম্পর্কের কথা ছিল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান যেভাবে কাজ করছে তা ওর মধ্যেই পড়ে। বলা যায় কিছুটা এগিয়েও গেছে। আশা করছি, মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্টটা এগোবে। ভুটান তাদের অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে এখনো রাজি নয়, আশা করছি তারাও রাজি হবে।

তবু সার্কের উপ-আঞ্চলিকতা আছে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংকটটা যতক্ষণ না মিটছে, ততক্ষণ সার্কের মাধ্যমে এগোনো যাবে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল কোনো জায়গা যদি থাকে, যেখানে সবগুলো দেশ একত্রে দাঁড়াতে পারে, সেটা সার্ক।

এখানেই দেখেছি সার্কের ক্ষেত্রে চীনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আনা হয়েছিল। এটা আমরা অনেকদিন ধরেই দেখছি এবং গত দুয়েক বছরে আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন তাদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত সমস্যা মিটছে না। লাদাখে সীমান্ত সংকট হলো। একটা সময়ে আপনারা দেখেছেন একটা প্রেসিডেন্সিয়াল মিটিং চলছিল, সে সময়েই আরেক দিকে অ্যাটাক হলো। সে দেশটিকে কী করে আমরা বিশ্বাস করব?

আমরা জানি, আমাদের বাণিজ্য, অর্থনীতি এখনো চীনের সঙ্গেই বেশি সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু সেটা বাণিজ্যের দিক থেকে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সেটা খুবই অনিশ্চিত। একটা বিষয় আমি নিজের নানা লেখায় লিখেছি যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন কোনো পদক্ষেপ নিলে সেটা ভারতকে উদ্দেশ করে নেয়া হয়। অর্থাত্ বাংলাদেশ, নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে চীনের সব সময় চিন্তা থাকে ভারতকে কী করে কোণঠাসা করা যায়। বস্তুত আমি এটাও বলি, দক্ষিণ এশিয়ায় যদি দেখি একটা দেশ চীন বা ভারতের সঙ্গে মান (আদর্শ) রক্ষা করে কাজ করতে পেরেছে সেটা বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন নেপাল-ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে কিছুটা শ্লথ গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেন?

যোগাযোগ একটা আন্তঃসম্পর্কের বিষয়, সেটা ’৬৫-পূর্ব সময়ে একটা দেশের মতো সবাই সহজে চলাচল করতে পারত। সীমান্তে আটকে পড়তে হতো না। সে রকম একটা ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। আগে বোধহয় পাঁচটা রেললাইন ছিল, এখন তিনটা হয়েছে। বাকি সড়কগুলোও ’৪৭-পূর্ববর্তী সময়ের মতো করার চেষ্টা চলছে। আরেকটা বিষয় আমরা সব সময় স্বীকার করি যে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নর্থ ইস্টে ট্রানজিট পেয়ে আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে। ইনল্যান্ড ওয়াটার সিস্টেম আপনারা যেভাবে সুন্দর করে রাখতে পারেন, আমরা পারি না। আমরা চেষ্টা করি। এ প্যানডেমিকে যখন স্থলবন্দর বন্ধ ছিল, তখন আমরা বাণিজ্যের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবহার করেছি।

আমাদের অন্যতম লক্ষ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে গ্লোবাল ভ্যালু চেইন তৈরি করা। আমরা চেষ্টা করেছি নর্থ ইস্টের ফল, সবজি ইত্যাদি নিয়ে যেন কাজ করতে পারি। নর্থ ইস্টে আপনাদের প্রাণ (কোম্পানি) এসেছে। আগরতলায় কারখানা করার জন্য তারা আগেও চেষ্টা করেছিল, এখন আবার নতুন করে হচ্ছে। একসঙ্গে কাজ করে আমরা পণ্য রফতানি করব। এই যে আমরা একসঙ্গে এগুলো উত্পাদন করছি, রফতানি করছি এটা থেকে দুই দেশই উপকৃত হবে। বাণিজ্য অনেক শক্তিশালী হবে। যেটা যোগাযোগের মাধ্যমেই সম্ভব।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে নেপাল-ভুটানের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। আমি যে সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি, সেখানেও এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। যেমন আমাদের ধারণা নেপালে অনেক জায়গা আছে, যেখানে আমরা কোনো ফ্যাক্টরি তৈরি করতে পারি। বাংলাদেশে শ্রমিক আছে, আমাদের হয়তো প্রযুক্তিগত জ্ঞান আছে, সেই সঙ্গে আমরা যদি কাঁচামালগুলো ভুটান বা আমাদের নর্থ ইস্টে উত্পাদন করতে পারি, তাহলে এ অঞ্চলকে বাস্তবিকভাবে এগিয়ে নেয়া যাবে। পরিবহন ব্যবস্থা একদিকে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কাজে লাগছেই, অন্যদিকে ব্যবসার ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যায়। দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংযুক্তি সম্ভব। আশা করছি মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্টটা হলে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারব। কাজটা এগোচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবকিছু একটু সময় নিয়ে হয়। এখানেও হয়তো তাই হবে। আমি বিশ্বাস করি, প্রাকৃতিক যোগাযোগ বাড়লে মানুষে মানুষে যোগাযোগও বাড়বে। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে ফরেন পলিসি আসলে মানুষের যোগাযোগকে নেতৃত্ব দেয়। কারণ, নেতৃত্ব থাকবে, সরকার থাকবে কিন্তু মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সম্পর্ক যদি সুন্দর জায়গায় না থাকে, তাহলে কোনো বৈদেশিক নীতি কার্যকর হয় না।

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতে কোনোকিছু রফতানি করতে গেলে প্যারা ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ইত্যাদি বাধা পার করতে হয়। এগুলো এড়ানো যাচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছা আছে কিন্তু অগ্রগতি ধীর কেন?

আপনাদের এই যে এত বড় তৈরি পোশাক শিল্প, একটা সময় আমরা অফিশিয়ালি আপনাদের কাছ থেকে পণ্য নিতাম না কিন্তু দেখতাম নর্থ ইস্ট ভরে গেছে আপনাদের পণ্যে। আবার আমরা যখন নিজেরা বাংলাদেশে যাই, ব্যাগ ভর্তি করে পণ্য নিয়ে আসি। কিছু বছর হলো আমরা অফিশিয়ালি এটা নিচ্ছি। ২০১২ থেকে নন-ট্যারিফগুলো যতটা কমানো যায় তার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এখনো আছে।

আবার প্যারা ট্যারিফ যেগুলো বলছেন, আসলে নানা দেশের সঙ্গে নানা ধরনের কাজ চলছে। সাউথ ইস্ট এশিয়ায় বিরাটভাবে কাজ হচ্ছে। এদিকে রাশিয়া ইউরোপ আছে। সাউথ এশিয়ায় আমরা অনেক চেষ্টা করি। প্রাইম মিনিস্টার মোদি বারবার প্রতিবেশীর কথা প্রথমে বলেন।

তবে এটা যদি আমরা জানতাম, ওখানে আসলে কী সমস্যা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা কেন এগোতে পারছেন না তাহলে ভালো হতো। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে সিঙ্গেল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্সের কথা বলেছি। ক্লিয়ারেন্সগুলো খুব জটিল হয়ে যায়। আবার পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিকের মান সনদ ভারত গ্রহণ করতে পারছে না—এগুলোর কারণে একটু সময় লাগছে। এগুলো একটু দ্রুত করা গেলে মানসিক সংকটের দিকটা ঠিক করা সহজ হতো।

সময় লাগছে কারণ আমাদের মিনিস্ট্রির আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত বেশি যে চাইলেও দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে নানা ধরনের প্লাটফর্মে এগুলো যদি জানিয়ে দেন যে এই এই বিষয়ে আমাদের সমস্যা, এগুলো আমরা চাই, প্রয়োজন—আমাদের দিক থেকেও মিনিস্ট্রি সেগুলো ঠিক করতে চাইবে। আমরা বিশ্বাস করি রিজিওনালি বাংলাদেশ আমাদের পার্টনার। আমরা যদি বেশি করে আপনাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারি আমাদেরও সুবিধা হবে।

আমরা ভাবছি কেমন করে কমোডিটি বেজটা বাড়ানো যেতে পারে। ভ্যালু চেইন নিয়ে আমি একটু কাজ করছি, সেখানে এ ব্যাপারগুলো আসবে যে ছোট ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো কেন আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না। এমন না যে আমরা চিহ্নিত করতে চাই না কিন্তু চাপের কারণে সম্ভব হয় না। তবে আশা করছি, আপনারা যত এসব নিয়ে আলোচনা করবেন, নানা প্লাটফর্মে কথা তুলবেন, বিষয়টা তত ইতিবাচক দিকে এগোবে।

আপনি বলেছেন সাউথ এশিয়ান রিজিওনে কেউ যদি চীন ও ভারতের সঙ্গে ব্যালান্স করে চলতে পেরে থাকে সেটা বাংলাদেশ। এই যে ব্যালান্স করা বা ব্যালান্স করতে হবে এমন একটা মনোভাব এটার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

এটা যদি ভারতের কোনো নেতাকে জিজ্ঞেস করা হয় তারাও বলবে আমরা এত সহায়তা করছি, আমাদের সঙ্গে কেন কাজ হচ্ছে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন যেভাবে সহায়তা দিয়েছে—রাস্তা, ব্রিজ থেকে শুরু করে সামরিক ক্ষেত্রে—সেটার তো একটা স্বাভাবিক প্রভাব থাকবেই। চীন বাংলাদেশে নিজেদের একটা জায়গা করে নিয়েছে। হালে কিছুটা দেখছি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, চীন সুন্দর করে সম্পর্ক রেখেছে কারণ এটা উভয়েরই দরকার। এতে কাজ এগিয়েছে এবং প্রজেক্টগুলো দ্রুত হয়েছে। কিছু হয়তো একটু এদিক-ওদিক হয়েছে কিন্তু মোটের ওপর সেটা নজরে পড়ার মতো না।

চীন, জাপান বা আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের যে কাজ হচ্ছে, তাতে আমাদের কিছু বলার নেই কিন্তু চীন যেভাবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা বা এর আশপাশে সেটা যেন কোনো অ্যান্টি ইন্ডিয়ান অবস্থানকে সহায়তা না করে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আমি এটা বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কাজ করার পেছনে সব সময় ভারতবিরোধী মনোভাব কাজ করেছে। কারণ এশিয়াতে কেউ যদি তাদের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে, সেটা ভারতবর্ষ। তবে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এ বিষয়ে সংবেদনশীল যে ভারতের কোনটা চিন্তা। কিন্তু সরকার তো বদলায়, তাই চিন্তা হচ্ছে বন্দর, রাস্তাঘাটে চীন যেভাবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে, বাংলাদেশে তাদের একটা ভৌগোলিক উপস্থিতি তৈরি হয়েছে যেটা আগে ছিল না। সেখান থেকে যদি তারা সুযোগ নেয়, তাহলে ভারত শক্ত অবস্থান নেবে। কিন্তু তাই বলে কখনই বলছি না যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে কাজ করবে না। এটা কোনো বাস্তব কথাও নয়। আমরা জানি, বহু জায়গায় বাংলাদেশে চীনের অবদান রয়েছে, বাংলাদেশ উপকৃত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যেমন—নদীর পানি বণ্টন ও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড। ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন? 

আমি বারবার বলি যে আমরা সমাধান চাই। যখন আমরা ঢাকায় এসেছি এ বিষয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। সীমান্তে এ সহিংসতার অন্যতম কারণ কিন্তু অনৈতিক ব্যবসা। গোলাগুলির সময় ভারতীয়রাও আহত হয়। ভারত থেকে বলা হয়েছিল, সন্ধ্যার পর যেন চলাচল বন্ধ করা হয়। তাহলে আমরা এ সমস্যা কিছুটা কমাতে পারি। কিন্তু শেষবার যখন কথা হয়েছিল তখন বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এখন আমরা যতই আলো দিই বা যা-ই করি, ওখানে গাছপালা পার করে দেখা যাবে না কে আছে। চোরাকারবার, মাদক পাচার থেকে শুরু করে মানুষ পাচার পর্যন্ত সব ধরনের অপরাধ কিন্তু অন্ধকারেই হয়, জলপথেও হয়। গরু নিয়ে অনেক কথা হতো। এখানে বহু ধরনের কথা হয়েছে যে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে, দেখতে হবে কে আছে কিন্তু তবু কোথাও যেন খামতি থেকে যাচ্ছে।

সীমান্তে অনৈতিক ব্যবসা কীভাবে কমানো যায় সেটা দেখতে হবে। দুই দেশেই এক ধরনের মিডলম্যান আছে যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করে। এখন এটা কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা দুই দেশ মিলেই ঠিক করতে হবে। দুটো বর্ডার ফোর্স একত্রে কাজ না করলে সমাধান সম্ভব হবে না। আরেকটা যেটা আমি নিজের কাজ থেকে অনেক সময় বলি লোকাল যে বর্ডার কমিউনিটি আছে সেটা যদি আমরা উন্নত করতে পারি তাহলে ভালো হয়। আমাদের বর্ডার এলাকার মানুষের ভাষা কিন্তু প্রায় এক। সেখান থেকে ছেলে-মেয়েদের কমন স্কুলে পড়ানো যেতে পারে। বর্ডার হাটের উদাহরণ আছে আমাদের কাছে, যেখানে একসঙ্গে ব্যবসা হচ্ছে। ‘কো-প্রসপারিটি অব বর্ডার ইকোনমি’ করতে পারি। তাহলে আমার ধারণা বর্ডারের নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমবে। আগে নিরাপত্তাই প্রধান চিন্তা ছিল ফলে মনোভাব তৈরি হয় যে আমরা সবকিছু আটকে রাখব। কিন্তু এখন তো আমরা বন্ধু দেশ, তাহলে কেন সীমান্তের কড়াকড়ি শিথিল করে দিতে পারি না। সেখানে মানুষ সহজভাবে চলাচল করতে পারবে। তাহলে একসঙ্গে ব্যবসা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সহায়তা হতে পারে। এ প্যানডেমিকে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এগুলো নজর দিলে নেতিবাচক প্রভাব কমবে।

আমি আগেও ঢাকায় দাঁড়িয়ে বলেছি, এখনো ক্ষমা প্রার্থনা করছি কিন্তু ওই মুহূর্তে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না যে কার ওপর গুলি চালানো হচ্ছে। আমাদের দুই দেশের মানুষের শারীরিক গঠন প্রায় একই রকম। তবু যেটা হচ্ছে সেটা বাংলাদেশ বা ভারত কারো জন্য ভালো নয়।

নদীর পানির বিষয়টা আমি সব সময় মেনশন করি যে বাংলাদেশকে যদি প্রশ্ন করা হয় তোমার কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশ বলবে ‘পানি’। ২০১০ সালে আমরা ওয়াটার বেসিন নিয়ে কথা বলেছিলাম। বাংলাদেশ থেকে ৫৪টি নদী নিয়ে একটা চুক্তির কথা বলা হয়, যেটা আসলে সম্ভব নয়। একেক নদীর একেক উত্স, ধারা ইত্যাদি। কিন্তু যে মুখ থেকে একাধিক নদী উত্পন্ন হচ্ছে, সে বেসিন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আমরা ২০১০ সালে চুক্তি করেছিলাম। ২০২১ সালে এসে ছয়টা নদী নিয়ে কথা কেবল এগোচ্ছে, এটা লজ্জার বিষয়। বাংলাদেশের যেটা ধারণা জলের প্রবাহটা ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এ জায়গাটাতে চাইব যেন কথা এগিয়ে যায়।

আমি ছোটবেলা থেকে তিস্তা দেখেছি। একটা সময় যেখানে থইথই করে জল আসত, এখন কুলকুল করে আসে। পানির সেই ধারা আর নেই। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এসব হয়ে গেছে। তিস্তা চুক্তি যখন হয়েছিল কোনো দেশের কাছেই পানির পরিমাণ সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। আমরা বলেছিলাম তিস্তা প্রবাহিত হচ্ছে আমরা আপনাদের কিছু পানি দেব, গ্যারান্টি দিচ্ছি।

জল প্রয়োজন চাষবাসের জন্য। পশ্চিম বাংলায়ও প্রয়োজন কিন্তু এখন বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কম জলে প্রচুর ফসল উত্পাদনের মতো বীজ তৈরি হয়েছে। তাই বলছি কথার জায়গাটা, ন্যারেটিভটা বদলানোর সময় এসেছে। পানির সমস্যাটা দুই বা তিন মাসের, সারা বছরের নয়। এখন আমরা কেন বাংলাদেশকে জিজ্ঞেস করছি না যে পানির জন্য ফসলের কোন চাষটা আটকে যাচ্ছে? সেটা আমরা কি অন্য জায়গায় করে দিতে পারি না? একইভাবে সেটা আমাদের ক্ষেত্রেও হতে পারে।

বাংলাদেশ মনে করছে কৃষির জন্য আমরা জল আটকে রাখছি। যে ফসলটা আমরা উত্পাদন করতে পারছি না, সেটা বাংলাদেশ থেকে কেন নিই না? আমাদের চাষবাসের ধরন, সময় অনেকটাই এক। আমরা কেন বন্ধু দেশ হিসেবে পরস্পরের পরিপূরক হতে পারি না এ জায়গাটা আমি বুঝতে পারি না। পানির প্রবাহ তো কাজের জন্য প্রয়োজন, সেটা কেন দুজন বসে ঠিক করতে পারি না যে তোমার কত কুইন্টাল চাল দরকার, ডাল দরকার বা অন্য কিছু, যেটা আমরা তৈরি করে দিতে পারব। আমাদের যেটা দরকার সেটা তোমরা করে দিতে পারবে। আমার মনে হয় কথার ধরনটা অন্যদিকে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে কেননা প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে।

ধরুন বর্ষার সময় আমরা পানি ধরে রাখতে পারছি না, যেটা শুষ্ক মৌসুমে ছাড়তে পারব। এ কথোপকথনটা হতে পারে। সীমান্তে আমরা এমন ব্যবস্থা করতে পারি যে যখন পর্যাপ্ত পানি থাকছে তখন দুই দেশেই প্রবাহের কারণে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন পানিটা ধরে রেখে পরে কাজ করতে পারি। কথাগুলো এভাবে কেন এগোনো যাচ্ছে না এটা আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে গেলে জল নিয়ে কথা বলতে হবে, একটা রেজল্যুশন নিশ্চয়ই আনতে হবে।

ভারতের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ কিছুটা বিব্রত। যেমন—এনআরসির কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি। আবার বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান, এটা ভারতেও দেখা যাচ্ছে। এ চাপগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা যায়?

এটা দুই দেশেই দেখেছি নিজেদের পলিটিক্যাল কনস্টিটুয়েন্সিকে নিজের হাতে রাখার জন্য নানা মন্তব্য, বক্তব্য দেয়া হয়, যা একদম ঠিক নয়। একদিকে আমরা এত কাজ করার কথা ভাবছি কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এমন কিছু মন্তব্য করছেন যে সেটা খুবই দুঃখজনক। সেটা দুই দেশই সম্ভবত বুঝতে পারে যে রাজনৈতিক কনস্টিটুয়েন্সির কারণে এটা করতে হয়। কিন্তু বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষ সবাই সম্পর্কটা ভালোই রাখতে চায়। বাংলাদেশ থেকে যারা চিকিত্সা কিংবা অন্য কারণে ভারতে আসে, তাদের মধ্যেও এটাই দেখেছি। একটা ছোট গ্রুপ আছে যারা চরমপন্থী আচরণ করে। একদিকে ইসলামী মনোভাব বাড়লে আমরা দেখি আমাদের গেরুয়ার আধিপত্য বাড়ে। একটা রেসপন্স-রিঅ্যাকশনের অবস্থা চলতে থাকে। এটা কোনোভাবেই কোনো দেশের পক্ষে ভালো না। আমাদের সঙ্গে আপনাদের আদর্শ-দর্শন আলাদা কিন্তু সেটা যখন কারোর ক্ষতির কারণ হয় তখন সেটা দেখতে হবে। আমরা এখানে বসে হয়তো মনে করি ওরা কিছু ভাবে না কিন্তু যতবার আমি বাংলাদেশে গেছি দেখেছি তারা এনআরসি নিয়ে কথা তুলেছে।

আমরা দেখেছি তখন প্রাইম মিনিস্টার মোদি আপনাদের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না। এগুলো নিয়ে খোলাখুলি যত কথা বলতে পারব, তত সমাধানের দিকে যাওয়া যাবে। কিন্তু সরকারের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। এর বেশি তো তারা বলতে পারবেন না। কিন্তু মানুষের কাছে যাদের যাতায়াত বেশি—তারা যদি এগুলো তুলতে পারেন তাহলে ভালো হয়। সেটা আমাদের এখানকার বিষয় হোক বা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যা হলো এসব নিয়ে সংলাপ, আলোচনা বাড়ানো উচিত। রাজনীতি, ব্যবসা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যোগাযোগ আরো বাড়ানো দরকার। সংস্কৃতির দিক থেকে এখন অনেক ভালো যোগাযোগ হচ্ছে। এখানে থেকে দুই দেশের প্রজন্ম যদি খোলাখুলি বলে তাদের কী সমস্যা, কী চাহিদা তাহলে আমার মনে হয় সমাধান সহজ হবে।

রোহিঙ্গারা যখন আসতে শুরু করল বাংলাধেম আশা করেছিল ভারত আমাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু দেখা গেল চীন মিয়ানমারের পক্ষে এবং ভারতও সে রকমই। যে সহযোগিতা আশা করেছিলাম সেটা পাওয়া গেল না। এমনটা কেন হলো?

দেখুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তো আমাদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। আপনি আগেও নিশ্চয়ই নজরে নিয়েছেন যে সরকার আছে বা আগে ছিল নর্থ ইস্টকে শান্ত রাখতে তাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন হয়। আদিবাসীদের এত ওভারল্যাপ আছে তাদের সঙ্গে যে এটা এড়ানো সম্ভব নয়। এ কারণে নর্থ ইস্টে অনেক বছর ধরে নানা ধরনের অস্থিরতা আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক ধরনের সহিংসতা দেখেছি। সে কারণে মিয়ানমারের সহযোগিতা আমাদের খুব দরকার।

রোহিঙ্গার ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি আমরা অফিশিয়ালি কিছু বলিনি। কিন্তু এর মধ্যে যতবার আমরা মিয়ানমার গিয়েছি এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমি নিজে চট্টগ্রাম গিয়েছি ক্যাম্পে তাদের দেখতে। রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু লেখা লিখেছি এবং অনেকে আমাকে জানায় যে লেখার কারণে তারা খুশি, আমরা তাদের নিয়ে ভাবছি। কিন্তু পয়েন্ট হচ্ছে, আমরা যদি জোর করে তাদের বলি তারা মানবে না। আমরা জানি রোহিঙ্গা বিষয়ে অফিশিয়ালি সমর্থন না করায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ। এ সময় তাদের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু আন্তর্জাতিক নানা প্লাটফর্মে কিন্তু ভারত মিয়ানমারকে এসব নিয়ে কথা বলেছে। রাজনৈতিক কারণে স্পষ্ট করে অফিশিয়ালি তাদের বলা সম্ভব না হলেও নানাভাবে তাদের সেটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

শ্রুতলিখন: মাহমুদুর রহমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন