পানি ব্যবস্থাপনা ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়

ড. আইনুন নিশাত

আজ আমাদের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। এদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছেন। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে ভারতের সহযোগিতা অবশ্যই কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতে হবে। ভারতীয়রা বলে থাকেন, ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। কাজেই তাদের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

এখানে আমার দুটো কথা। এক. ভারত সহায়তা না করলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। বিশ্বে দুটো নজির আছে। একটি হলো নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশ, যারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হতে পারেনি। আরেকটি হলো ইরিত্রিয়া। ইথিওপিয়ার একটা অংশ ছিল। তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ৩০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। আমার জবাব হচ্ছে বাংলাদেশ ইরিত্রিয়ার মতো হতো, বায়াফ্রার মতো পরাজিত হতো না। এটাই ছিল আমাদের মনোবল। দুই. ভারত সহায়তা করেছে, কথা আমরা চিরকাল মনে রাখব। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ভারতের যেকোনো ধরনের কথা, হস্তক্ষেপ মানতে আমরা বাধ্য। এখানে আমার একটা উদাহরণ মনে পড়ছে। আজকের যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর বৃহৎ অংশ ব্রিটেনের অধীনে কিছু স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। এটা আমরা অনেকেই জানি না ব্রিটেনের কিছু স্বাধীন রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করেছে। একই সঙ্গে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় অংশ মেক্সিকোর অংশও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো যুদ্ধে মেক্সিকো পরাজিত হয় এবং পুরো মেক্সিকোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করে নেয়। পরবর্তী সময়ে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ যুদ্ধে দখল নেয়া মেক্সিকোর কিছু অংশ মেক্সিকোকেই দিয়ে দিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের। আর কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্র কিনে নেয়। এর মধ্যে নিউ মেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি অঙ্গরাজ্য রয়েছে।

যে কথা আগেই উল্লেখ করেছি সেটি হলো ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যখন মার্কিনরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন তাদের দলনেতা ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। যিনি পরবর্তী সময়ে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে অন্য নেতা যারা ছিলেন তাদের কয়েকজন পরে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। তারা নতুন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন হিসেবে পেলেন। তখন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা চায় ফ্রান্সের কাছে। ফ্রান্স সহায়তা দিতে রাজি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কোনোমতে টিকে যায়। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ফ্রান্স স্ট্যাচু অব লিবার্টি তৈরি করে সমুদ্রপথে নিউইয়র্কের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আজ যুক্তরাষ্ট্রে কেউ বেড়াতে গেলে এবং সময় থাকলে অবশ্যই এই স্ট্যাচু দেখতে যায়। এটা আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক।

এই যে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জয়ী হতে, স্বাধীন হতে সাহায্য করল এবং নতুন রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে সহায়তা করল এজন্য অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তার অর্থ এই নয় যে ফ্রান্স যা বলবে যুক্তরাষ্ট্র তাই মেনে নেবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে লক্ষ করছি, যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলে অস্ত্রসংক্রান্ত একটি চুক্তি করেছে, যেটিতে ফ্রান্স অত্যন্ত নাখোশ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রায় ক্ষমা চেয়েছেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নতুন করে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

বিশ্বের দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে জোট তৈরি হলে সেখানে শুধু কৃতজ্ঞতাবোধ দ্বারা সবকিছু পরিচালিত হয় না। উল্টোভাবে, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের চরম শত্রুতা থাকলেও সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যাবে না, সেটিও সঠিক কথা নয়। জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড দুইবার বিশ্বযুদ্ধ করেছে। আজকে জার্মানির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো ফ্রান্স। জার্মানি পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম সব দখল করে নিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে এসে যুদ্ধ থেমেছে। তার সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। তীব্র বিরোধিতা। দুইবার ফ্রান্সকে পরাজিত করেছে জার্মানি। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড অন্য দেশ মিলে আমেরিকার সহযোগিতায় তাদের পরাজিত দেশকে আবার স্বাধীন করেছে। বলতে চাইছি, দুটো বিশ্বযুদ্ধের তিক্ততা যে এখনো ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড মনে রাখবে তা নয়। সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাদের মনের মধ্যে তিক্ততা আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তারা কিন্তু জোট তৈরি করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পরিচালনা করছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে জার্মানি অত্যাচার করেছিল এবং যে অত্যাচারের ওপর প্রায়ই আমরা ডকুমেন্টারি ছবি দেখতে পাই। তাতে বুঝতে পারি, কী অত্যাচার হয়েছিল। জার্মানি তার স্বদেশ এবং দখলকৃত দেশগুলোতে ইহুদিদের ওপর যে অত্যাচার করেছিল, সেটি ইহুদিরা ভুলতে পারে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক তারা গড়ে তুলবে না।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রেও মেলানো যায়। বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অপশক্তিকে পরাজিত করেছিল। তার জন্য ৫০ বছর পরে এসে ১৯৭১ সালে ভারতের অবদান আমরা অবশ্যই মনে রাখব এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। কিন্তু এখন গত ৫০ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আমাদের এমনভাবে এগোতে হবে যাতে দুই দেশই উপকৃত হয়। এক দেশের স্বার্থের বিনিময়ে অন্য দেশ লাভবান হবে, এখন এটা আর গ্রহণযোগ্য নয়।

আমি কয়েকটা বিষয় চিহ্নিত করতে চাই। স্বাভাবিকভাবে প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি। আমি যেহেতু কাজে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলাম, সেহেতু আমি এখন থেকে ২০-৩০ বছর আগে লক্ষ করেছি, অভিন্ন নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের যে পুরোপুরি অধিকার আছে, সেটি কেন যেন ভারত স্বীকার করতে চাইত না। অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেই সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকতে হবে কথা বলে অববাহিকতার কথা তারা উপেক্ষা করার চেষ্টা করত। এটি কোনোমতেই সঠিক পদক্ষেপ ছিল না।

সম্প্রতি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের রাজনৈতিক নেতারা যথেষ্ট প্রজ্ঞা জ্ঞানের পরিচয়  দিচ্ছেন। এখন থেকে ১০ বছর আগে ২০১১ সালে বাংলাদেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার দীর্ঘমেয়াদি যে রূপরেখা তৈরি করেছেন এর ভিত্তিতেই দুই দেশ সম্মানজনকভাবে এগিয়ে যেতে পারে। এই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ২নং ধারায় বলা হয়েছে, এখন থেকে দুই দেশ নদীভিত্তিক অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। এখানে দুটো বিষয়ের দিকে আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রথম কথা, পানির বণ্টন নয়, পানির ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে যে অভিন্ন নদীগুলো আছে সেখানকার পানিতে সারা বছরের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে আসা যায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। বন্যা সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, খরা মোকাবেলা সম্ভব, নদীভাঙন ঠেকানো সম্ভব এবং ভবিষ্যতে যে পানির চাহিদা বাড়বে বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তারও একটা সম্মানজনক সমাধান করা সম্ভব। ২০১১ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার ভিত্তিতেই আগামী ৫০ বছরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা উচিত।

গত ৫০ বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা সুমধুর ছিল না। গত ১০ বছরে পরিবর্তনের আভাস দেখতে পাচ্ছি। যেসব সন্ত্রাসী বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতে উৎপাত করত তাদের সমূলে উৎপাটিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে। সেই সঙ্গে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর নামে বাংলাদেশে যে দুরবস্থা ছিল সেটি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সংযুক্ত এবং যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন বাধা দেয়ার পরে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে আশুগঞ্জকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এক আলোচনায় মিলিত হয়েছিল সম্পর্ক আরো উন্নয়নের জন্য। একই সঙ্গে গঙ্গা পানি চুক্তি বা গঙ্গার পানি বিনিময়ে অচলাবস্থা দুই দশকের সম্পর্ককে তিক্ত করেছিল। যে চুক্তিটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, সেটি পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। নবায়নের সময় এসেছে। এখন আমি আশা করব, দুই দেশের বিজ্ঞ আলোচকরা এটিকে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে নিয়ে যাবেন। পানি বণ্টনের চিন্তাভাবনা পরিহার করে পানি ব্যবস্থাপনার দিকেই এগোতে থাকবে। কাজে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? কাজে ভারত কি প্রস্তুত? আমার জানা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আমার আকুল আবেদন তিন-পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি আর করবেন না। দু্ই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে, যদি না সম্মতভাবে তার পরিবর্তন ঘটানো হয় এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে নদীর সংখ্যা নিয়েই বিরোধ আছে, সবাই বলেন ৫৪টি নদী। আমি মানতে রাজি নই। অন্ততপক্ষে আরো ১৫-২০টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী আছে। ২০১১ সালের চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিটি নদীর জন্য নদীভিত্তিক অববাহিকাভিত্তিক সমঝোতা করা উচিত। যেসব নদীতে আমাদের জরুরি ব্যবস্থা প্রয়োজন সেগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে নিতে হবে। ৪০ বছর ধরে ছয়টি নদী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা দুধকুমার। তার সঙ্গে তিস্তা নিয়ে আলোচনা চলছে প্রায় ৭০ বছর ধরে।

অববাহিকাভিত্তিক আলোচনায় বিশেষ করে তিস্তা নদীর সমস্যা সমাধান করা মোটামুটি সহজ কাজ। কারণ তিস্তা কেবল বাংলাদেশ ভারত দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত। ধরলা, দুধকুমারে ভুটান অংশীদার আছে। বাকি নদী মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী কিংবা আমাদের পশ্চিমের দিকে যেসব নদী আছে সেগুলো অববাহিকাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে সক্ষমতার কিছু অভাব আছে। কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম অগ্রগামী দেশ। তারা তাদের আন্তঃপ্রদেশের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি বটে, কিন্তু সেই ব্যাপারে তারা যে পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে একই পদক্ষেপ বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর ক্ষেত্রে আনা যেতে পারে।

একটি নদী অববাহিকায়, একটি নদী সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের অববাহিকার ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা যেহেতু ভাটির দেশের লোক উজানে কী হচ্ছে তার প্রভাব আমাদের ওপর পড়তে বাধ্য। ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো করতে পারলে নদী ভরাট হওয়ার ফলে বাংলাদেশ যে কষ্টের মধ্যে আছে তা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। দুই দেশের মধ্যে ইকোসিস্টেম বেজড অ্যাপ্রোচ হওয়া উচিত। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার কথা দুই দেশ এখন ভাবতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কাজেই পানির ব্যবস্থাটি আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সমাধানের দিকে যদি না এগোয় আমার ভয় হলো পাঁচ বছর পরে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা পুনরায় উজ্জীবিত হবে। সাধারণ মানুষ গঙ্গা কিংবা অন্যান্য নদীকে শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা দেখছে।

উজানে বর্ষার পানি ধরে রেখে শীতকালে ছাড়তে পারলে বন্যা বা খরা মোকাবেলা যেমন সহজ হবে, তেমনি একইভাবে প্রচুর পানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। দিন আগে কাগজে দেখলাম বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে ভারত, নেপাল ভুটান অর্থাৎ অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় প্রচুর নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কাজটি জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের ভূমিকাকে সমুজ্জ্বল করতে পারে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত এখান থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। কারণ এখনো তাদের বিদ্যুতের একটা বড় অংশ কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত হয়। এটা যদি জলবিদ্যুতের মাধ্যমে হয় তাহলে পুরো অঞ্চলটাই উপকার পেতে পারে। এখন কাজ করতে গেলে পরিবেশগত সামাজিক কিছু সমস্যা উদ্ভব হবে। পরিবেশগত সামাজিক সমস্যা ঠাণ্ডা মাথায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব। এই চারটি দেশ ছাড়াও পঞ্চম একটি দেশ এর সঙ্গে জড়িত, সেটি হলো চীন। চীন উজানে কী করছে সেটি আমরা পরিষ্কারভাবে অতটা জানি না। ভারত উদ্বিগ্ন বলে আমরা জানি। এখানে ভারত বাংলাদেশ একত্রে বসে চীনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র চীন থেকে আসা নদীগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।

ভারত বাংলাদেশে যারা পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করেন, দুই দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে যারা ভাবেন এবং যাদের অববাহিকা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আছে তাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে যেখানে ভুল বোঝাবুঝি বা কোনো ধরনের জটিলতা আছে তা দূর করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ছোট একটা জটিলতার কথা উল্লেখ করি। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের তদানীন্তন প্রতিনিধিরা অভিন্ন সীমানায় যে ঝামেলা আছে তা দূর করার পদক্ষেপ নিয়েছিল, ছিটমহলের সমস্যা মেটানোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেটি দীর্ঘদিন পরে সমাধান হয়েছে বলে জানি। এটি আংশিক সত্যি, পুরোপুরি সত্যি নয়। ছিটমহলের সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু অভিন্ন সীমান্ত এখনো টুকরো টুকরো জটিল অবস্থায় আছে। বহু সীমানা চূড়ান্ত হয়নি। ধরনের অন্য ছোট ছোট স্থানে যদি জটিলতা থেকে থাকে তাহলে জরুরিভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটি সমাধান করা যেতে পারে।

নিবন্ধটি শেষ করছি আরেকটি বিষয় জোর দিয়ে। সেটি হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যবসা-বাণিজ্য বেশি হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বর্তমানে অসম পর্যায়ে আছে। এটিকে যদি নাড়াচাড়া করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো হয়, শিল্প-কারখানা স্থাপনে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো উন্নয়ন হবে। দুই দেশের মধ্যে কিন্তু আরো অনেক সমস্যা আছে। এগুলো আমরা দ্রুত সমাধান করলে এখন থেকে আগামী ৫০ বছর দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গভীর হবে। বোঝাতে চাইছি গত ৫০ বছর যা হয়েছে তা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। সেটিকে বাদ রেখে সামনের ৫০ বছরের কথা ভাবুন এবং সেখানে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিন। ভুলভ্রান্তিকে সরিয়ে রেখে দুই দেশের শক্তিকে জোরদার করার চেষ্টা করাটাই কাম্য।

 

. আইনুন নিশাত: পানিসম্পদ, পরিবেশ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক  

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন