পুনর্খননে প্রাণ পাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের পুকুর-দীঘি

ফেরদৌস সিদ্দিকী, রাজশাহী

রাজশাহীর মোহনপুরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের খনন করা পুকুর ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছে পানির উৎস ঘিরেই। প্রায় ৭০ হাজার পুকুর-দীঘি ছড়িয়ে রয়েছে অঞ্চলজুড়ে। গৃহস্থালি, কৃষিকাজ এমনকি খাবার পানির জোগান মিলত এসব জলাশয় থেকেই।

কালক্রমে প্রবাহ হারিয়েছে নদী। মজে গিয়েছে পুকুর-দীঘিগুলো। ফলে বৃষ্টিনির্ভর কৃষির উৎপাদন বাড়াতে চাপ বেড়েছে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে বিপ্লব ঘটলেও জোগান কমছে খাবার পানির।

ফলে সেই পুকুর-দীঘিতেই ফিরে যাচ্ছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর বগুড়া জেলার ৭১৫টি পুকুর এবং ১০টি দীঘি পুনর্খনন করবে বিএমডিএ। নিয়ে পুকুর পুনর্খনন ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।

বিএমডিএ সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ২৭৬টি পুকুর চারটি দীঘি পুনর্খনন প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ফলে সম্পূরক সেচের আওতায় এসেছে পাঁচ জেলার হাজার ১২০ হেক্টর ফসলি জমি। তা থেকে বাড়তি ফসল উৎপাদন হয়েছে হাজার ৭২০ টন। এছাড়া পুকুরে মাছ উৎপাদন হয়েছে আরো ৪২০ টন।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় এরই মধ্যে পুনর্খনন হয়েছে তিনটি পুকুর। উপজেলার জাহানাবাদ ইউনিয়নের ইসলাবাড়ী মৌজায় দেড় একরের একটি পুকুর খনন হয়েছে। পুকুরের দুই পাড়ে ইসলাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস ভূমিহীন ২০ পরিবারের। পুকুর পুনর্খননের ফলে বদলে গেছে স্থানী বাসিন্দাদের ভাগ্য।

বিষয়টি জানিয়েছেন পুকুরপাড়ের বাসিন্দা রিক্তা খাতুন। গৃহবধূ জানান, তার স্বামী মাসুদ রানা ভূমিহীন কৃষক। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। সম্বল বলতে পুকুরপাড়ে মাথা গোঁজার ঠাই টুকুই। নিজে গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন করেন।

বাড়ির আঙিনায় কিছু সবজি চাষ করেন। তাছাড়া পুকুরের মাছ বিক্রির টাকাও পান। সেই অর্থে সংসার চলে।

দুই দশক ধরে ইসলাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করছেন জমির উদ্দিন। তিনি বলেন, পুকুরটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। একটা সময় গিয়ে গোসলের পানিও পাওয়া যেত না। পুকুরটি পুনর্খনন করায় এখন সারা বছর পানি থাকে। সেই পানি সেচের কাজে লাগছে। তাতে নিজেরাই মাছ চাষ করছেন।

তাছাড়া পুকুরের পাড় ভেঙে বসতবাড়ির কাছে চলে এসেছিল। যাতায়াতের রাস্তাটুকুও ছিল না। পুকুর পুনর্খননের পর পাড় বেঁধে দেয়া হয়েছে। লোকজন চলাচলের রাস্তা পেয়েছে। কিছু জমিও বেরিয়েছে। সেখানে শাক-সবজি চাষ হচ্ছে। লোকজনের কষ্ট অনেকটাই দূর হয়েছে।

দুই বছর ধরে ইসলামবাড়ী পুকুরের চারপাশে অন্তত ৩০ জন চাষী পানবরজ গড়ে তুলেছেন। এদেরই একজন গুপইল এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত টানা আট মাস তারা পুকুরের পানিতে বরজে সেচ দেন। সময়টায় প্রতি সপ্তায় সেচ প্রয়োজন পড়ে। পুকুরটি পুনর্খনন না থাকলে পাশের বিল থেকে কলসি করে পানি এনে বরজ বাঁচাতে হতো। পুকুরটি পুনর্খনন হওয়ায় পানির কষ্ট আর নেই। তারাও বেশ উপকৃত হয়েছেন।

পুকুর খননের বিষয়ে বিএমডিএর মোহনপুর জোনের সহকারী প্রকৌশলী সানজিদা খানম মলি জানান, পর্যায়ক্রমে উপজেলায় ১১টি পুকুর পুনর্খনন হবে। এর মধ্যে তিনটি পুকুর পুনর্খনন হয়েছে। বাকিগুলো পুনর্খনন প্রক্রিয়া চলছে। পুকুর পাড়ে বসবাসরত ভূমিহীন লোকজন সেখানে হাঁস পালন, মাছ সবজি চাষ করে সংসার চালাচ্ছে। সম্পূরক সেচ সুবিধাও পাচ্ছেন চাষিরা।

বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ জানায়, পুকুর পুনর্খনন ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া নাটোরে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।।

কেবল পুকুর পুনর্খনন নয়, সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে ৮৫টি সোলার এলএলপি স্থাপন ৮০ কিলোমিটার ভূ-গর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় পুকুরপাড়ে লাগানো হবে দেড় লাখ গাছের চারা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি  প্রায় ৪০ শতাংশ।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শরীফুল হক বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭৬ পুকুর   চারটি দীঘি পুনর্খনন করা হয়েছে। এলএলপি বসানো হয়েছে ৩০টি। পানি সরবরাহে পাইপলাইন বসানো হয়েছে ৪০ কিলোমিটার। আর গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার।

তিনি বলেন, ভূ-গর্ভ পানির পুনর্ভরণ ছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবহারের মাধ্যমে হাজার ৫৮ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। এতে ১৮ হাজার ৩৪৮ টন অতিরিক্ত ফসল ফলবে। পুকুরের পানিতে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন হবে হাজার ৮৮ টন।

বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে পরিবেশ উন্নয়ন ছাড়াও প্রান্তিক চাষিদের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেচের আওতায় এসেছে হাজার ১২০ হেক্টর জমি। তা থেকে ফসল উৎপাদন হয়েছে হাজার ৭২০ টন। আর মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪২০ টন।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, শুরু থেকেই সেচের পরিধি বাড়াতে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে বিএমডিএ। একটা পর্যায়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমি বিএমডিএর সেচের আওতায় চলে আসে। এতে অঞ্চলে কৃষিবিপ্লব হলেও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে বন্ধ করা হয় গভীর নলকূপ স্থাপন। নদীনালার পানিতে বাড়তে থাকে সেচের আওতা। কিন্তু সেটিও পর্যাপ্ত নয়। ফলে বরেন্দ্র এলাকার বৃষ্টির পানি আহরণে খাস মজা পুকুর পুনর্খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় খাস পুকুর রয়েছে ১৪ হাজার। যেগুলো ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো পুনর্খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সুযোগ হলে পানি সেচের কাজে আসবে। তাছাড়া বৃষ্টির পানি ধারণ করলে সেটা পুনর্ভরণেও ব্যবহার হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন