আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার

কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চাশা

জেসমিন মলি

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির ব্যবহার প্রথম শুরু হয়। প্রযুক্তিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এটিকে একটি জাতীয় অর্জন হিসেবেই দেখছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে দেয়া এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

সংসদীয় কমিটি সুপার ক্রিটিক্যাল আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ারের ওপর বিদ্যুৎ বিভাগের একটি প্রতিবেদন দিতে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটিতে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল প্রভৃতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে জ্বালানির সহজলভ্যতা খরচ বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে হয়।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথমে বয়লার ফার্নেসে কয়লা পুড়িয়ে উচ্চতাপমাত্রার স্টিম (বাষ্প) উৎপাদন করা হয়। স্টিম টারবাইনের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত উচ্চচাপে চালনা করে জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাব-ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহূত বিভিন্ন প্রযুক্তির মধ্যে সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন, যা স্বল্প কর্মদক্ষতার এবং তুলনামূলকভাবে অধিক কার্বন নিঃসরণ করে। কারণে বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে সরে আসছে এবং সুপার ক্রিটিক্যাল আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০ সালে প্রথম সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির স্টিম জেনারেটর ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়, যার কমিশনিং শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহূত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি। প্রযুক্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা ৪৩ থেকে ৪৭ দশমিক শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে এবং কার্বন নিঃসরণের হারও সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির চেয়ে - শতাংশ কমে। প্রতিবেদনে প্রযুক্তিটিকে অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, প্রযুক্তিতে কম কয়লা পুড়িয়ে অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

বর্তমানে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাস্তবায়ন অগ্রগতিও সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন পুটয়াখালীর হাজার ৩২০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৩৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) বাস্তবায়নাধীন পায়রা হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (ফেজ-) আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে। প্রকল্পটির সামগ্রিক ইপিসি কাজের অগ্রগতি ২০ শতাংশ।

কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিএল) বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটির প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এবং দ্বিতীয় ইউনিট একই বছরের জুলাইয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৪৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) বাগেরহাটের রামপালে বাস্তবায়নাধীন মৈত্রী হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপার থারমাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

বেসরকারি খাতের এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন বাঁশখালী হাজার ২২৪ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটির কাজের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ।

এছাড়া ভারতে আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন আদানি হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটির প্রথম ইউনিট আগামী বছরের জানুয়ারিতে এবং দ্বিতীয় ইউনিট আগামী বছরের মে মাসে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে। প্রকল্পটির কাজের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৭৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ডেডিকেটেড ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি পণ্যগুলোর মধ্যে পরিবেশে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটায় কয়লা। কারণে বিশ্বব্যাপী এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার আওয়াজ উঠেছে। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা কমাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য কয়লার বৃহত্তম ভোক্তা দেশ চীনের ক্ষেত্রেও।

দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। বৈশ্বিকভাবেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে এরই মধ্যে সরে এসেছে অনেক দেশ। বাংলাদেশের ওপরও বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। যদিও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বলে সরকারের দাবি।

সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। অন্যদিকে ইউনেস্কোও ২০১৮ সাল থেকে রামপাল প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এত বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি, বিদ্যুৎ আমদানিও করছি। ফলে পরিবেশের ক্ষতি করে এমন প্রকল্প থেকে এখন বেরিয়ে আসতে হবে। উন্নত বিশ্ব কয়লা থেকে সরে আসছে। আমাদেরও বিকল্প উপায় থাকলে বেরিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন