শুধু ‘ছাইযুদ্ধ’ নয়, ঐতিহ্যেরও

লাইছ ত্বোহা

ক্রিকেটের ঐতিহ্যবহুল লড়াই অ্যাশেজের আরেকটি সিরিজ আসন্ন। আগামী বুধবার গ্যাবা টেস্ট দিয়ে শুরু হবে ২০২১-২২ সালের অ্যাশেজ। যাকে বলা হয়, ক্রিকেটের সবচেয়ে আদি দ্বৈরথ। 

এটা তো টেস্ট সিরিজ। তার পরও অন্যান্য সিরিজের চেয়ে একে নিয়ে বেশি আলোচনা ও গুরুত্ব এত বেশি কেন? তাও আবার এক শিশি ‘ছাই’ জিততে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে এ ধুন্দুমার ক্রিকেটযুদ্ধ! কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলে না। কেন এই চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা? দুই ক্রিকেট পরাশক্তির কাছে অ্যাশেজ কেন এত মহার্ঘ্যপূর্ণ লড়াই?

অ্যাশেজের বাংলা অর্থ ‘ছাই’ বা ভস্ম। এর নামকরণের দিকে তাকাতে হলে যেতে হবে টেস্ট ক্রিকেটের গোড়াপত্তনের দিকে। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বর্তমানে ‘টেস্ট’ নামে পরিচিত বড় ফরম্যাটে প্রথমবার মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ইতিহাসে প্রথম স্বীকৃত টেস্ট ম্যাচ এটি। সেই থেকে টেস্ট ক্রিকেট মানে অজি-ইংলিশ পরিবার।

ওই সময় ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম না থাকায় যতক্ষণ বা যতদিন খেলা যায় এমন চুক্তিতে টেস্টটি খেলতে নামে দুদল। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনির্ধারিত সময় হলেও চার দিনে নিষ্পত্তি হয় ম্যাচটি।

১৫ মার্চ শুরু হয়ে টেস্ট ম্যাচটি শেষ হয় ১৯ মার্চ। মাঝে একদিন (১৮ মার্চ) বিশ্রাম ছিল। ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ৪৫ রানে জিতে বড় ফরম্যাটে যাত্রা করে অস্ট্রেলিয়া। ওই অনির্ধারিত সময়ের টেস্ট খেলার পর যেন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের। সেই সুবাদে ১৮৮১ সালের মাঝমাঝি চার ম্যাচের সিরিজ খেলার সিদ্ধান্ত নেয় দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড। তাতেই ব্যাপকভাবে গতি পায় টেস্ট ক্রিকেট। নিজেদের মাঠে চার ম্যাচের ওই অনির্ধারিত সময়ের টেস্ট সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। 

এরপর ১৮৮২ সালে টেস্ট নিয়ে নতুন নিয়ম চালু করে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। অনির্ধারিত সময়ের টেস্ট নীতি বাদ দিয়ে তিনদিনের ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সেই সুবাদে ইংল্যান্ডের ওভালে ১৮৮২ সালের ২৮ আগস্ট তিনদিনের এক ম্যাচের সিরিজ খেলতে নামে দুদল। বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ হয় সেটি। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৩ রানেই অলআউট হয়ে যায় সফরকারীরা। জবাবে ইংল্যান্ডও ব্যাট হাতে খুব একটা যে সফল হয়েছিল, তা নয়। ১০১ রানে অলআউট হয় তারা। মাত্র ৩৮ রানের লিড পায় স্বাগতিকরা। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে কিছুটা ছন্দে ফেরে অস্ট্রেলিয়া। এইচএইচ মেসির ফিফটিতে ভর করে ১২২ রান করে অজিরা। জেতার জন্য তখন ইংল্যান্ডের দরকার মাত্র ৮৫ রান। 

নিজের মাটিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের এ রান তুলতে তেমন বেগ পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা বললে তো আর হয় না। অস্ট্রেলিয়াও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়। ডানহাতি ব্যাটসম্যান গ্রেসের ৩২ রানের ওপর ভর করে সর্বসাকল্যে ৭৭ রান করতে সক্ষম হয় ইংল্যান্ড। ফেড্রিক স্পফোর্থের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ৭ রানের জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে স্পফোর্থ ৪৪ রানে নেন ৭ উইকেট।

এভাবেই ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজটি জিতে নেয় সফরকারী অস্ট্রেলিয়া। ইংলিশ গণমাধ্যমে তখন ইংলিশ ক্রিকেটের ওপর রোষাণল ছড়িয়ে পড়ে। তখন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘দ্য স্পোর্টিং টাইমস’ তাদের প্রতিবেদনে ইংরেজ ক্রিকেট সম্পর্কে লেখে—‘ইংলিশ ক্রিকেটকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে ওভালের ২৯ আগস্ট, ১৮৮২ তারিখটি। গভীর দুঃখের সঙ্গে বন্ধুরা তা মেনে নিয়েছে। ইংলিশ ক্রিকেটকে ভস্মীভূত করা হয়েছে এবং ছাইগুলো অস্ট্রেলিয়াকে প্রদান করা হয়েছে।’

কথিত আছে, ওই সফরে মেলবোর্নের কিছু নারী দর্শক ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইভো ব্লাইকে কিছু ছাই প্রদান করে। পাত্রে রক্ষিত ছাই ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের মৃত্যুস্বরূপ প্রতীকী অর্থে দেয়া হয়েছিল। এভাবেই বিখ্যাত অ্যাশেজ সিরিজের সূত্রপাত। যাতে কেবল অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট সিরিজই অন্তর্ভুক্ত থাকে। 

এর পরের সিরিজের নামই দেয়া হয় ‘অ্যাশেজ’। তিন ম্যাচের ওই সিরিজ অনুষ্ঠিত হয় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। ১৮৮২ সালের ৩০ ডিসেম্বর শুরু হয় এ সিরিজ। ২-১ ব্যবধানে প্রথম অ্যাশেজ সিরিজটি জিতে নেয় ইংলিশরা।

এরপর ১৩৯ বছরের ইতিহাসে দুই বিশ্বযুদ্ধের কারণ ছাড়া কখনোই বন্ধ হয়নি অ্যাশেজ সিরিজ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯১২ সালের পর ১৯২০-২১ সালে ফের সিরিজ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩৮ সালের পর মাঝখানে ৭ বছর অ্যাশেজ হয়নি। ১৯৪৬-৪৭ সাল থেকে শুরু হয়।

১৮ থেকে ৩০ মাসের ব্যবধানে এ সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। 

অ্যাশেজের ইতিহাস প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাক্ষ্য দেয়। সর্বমোট ৭১ সিরিজে ৩৩ বার জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, ৩২ বার ইংল্যান্ড; ৬ সিরিজ অমীমাংসিত। অ্যাশেজে ৩৩৫ টেস্ট ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে দুদল। এর মধ্যে ১৩৬ ম্যাচে জয় অজিদের, ১০৮টিতে জয় পেয়েছে ইংলিশরা। ৯১ ম্যাচ ড্র হয়েছে। 

শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩, ৪, ৫ ও ৬ টেস্ট ম্যাচের অ্যাশেজ সিরিজ হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের অ্যাশেজ থেকে এখন পর্যন্ত এটি ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

কোনো কারণে সিরিজ ড্র হলে পূর্বেকার অ্যাশেজ বিজয়ী দলের কাছেই প্রতীকী ট্রফিটি রক্ষিত থাকে। সর্বশেষ ইংল্যান্ডে ২০১৯ সালের অ্যাশেজ সিরিজ ২-২ ড্র হওয়ায় বর্তমানে ট্রফি অস্ট্রেলিয়ার কাছে। কারণ ২০১৭-১৮ সালের অ্যাশেজ জিতেছিল তারাই।

কালের বিবর্তনে ভস্মাধারের এই যুদ্ধ এখন ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি ঐতিহ্যও। ছাই জেতাও যেন একটি সম্মান, একটি মর্যাদা। ঐতিহ্যের এই ‘লড়াইয়ে আবারো মুখোমুখি ইংলিশ ও অজিরা। আরেকবার ভস্মাধার নিজেদের করে নিতে লড়বে জো রুট ও প্যাট কামিন্সের দল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন