আলোকপাত

দারিদ্র্যের দরিয়ায়

আব্দুল বায়েস

দারিদ্র্য হচ্ছে দাহ; আপনি এটাকে দেখেন না, অনুভব করেন মাত্র; সুতরাং দারিদ্র্য সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে’—আদাবওয়া নামে ঘানার এক দরিদ্র।

এক. হে মহাজীবন কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলছেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি আবার ভাত দে হারামজাদা কবিতায় কবি রফিক আজাদের ক্রোধান্বিত অভিব্যক্তি, ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দুধভাতে উৎপাত গল্পে জয়নাবের দুধভাত খাওয়ার ইচ্ছা জাগলে ভুলবশত চালের গুঁড়িসহ ভাতকে দুধভাত মনে করে সে খায় এবং চাওয়ার অপূর্ণতা নিয়ে তার শেষ যাত্রা। এমনিভাবে ক্ষুধা দারিদ্র্যের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছে  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ইত্যাদি ছবি উপন্যাস। তবে স্বীকার করতেই হবে যে সময়ের বিবর্তনে সেই হাভাতে অবস্থা এখন আর নেই, যেমন নেই সরব দুর্ভিক্ষ, ভাগাড় কিংবা শকুনের শ্যেনদৃষ্টি। যেহেতু দারিদ্র্য বহুমাত্রিক, সর্বত্রই দারিদ্র্যের দহন আছে সত্যি, তার পরও কিছু না কিছু করে অথবা সরকারি-বেসরকারি দয়াদাক্ষিণ্যে মানুষ বেঁচে আছে মরার মতো। যা- হোক, একসময় আয় দারিদ্র্য তথা ক্যালরিভিত্তিক পরিমাপ নিয়ে মাতামাতি থাকলেও ইদানীং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিশ্লেষণ গুরুত্ব পাচ্ছে। একই সঙ্গে সহনীয় দারিদ্র্যের (মডারেট পুওর) প্রাধান্য থাকলেও চরম দারিদ্র্য ফোকাসে এসেছে পরিস্থিতি বিবেচনায়সম্ভবত একই ওষুধে দুই রোগের চিকিৎসা হয় না বলে। তবে সহনীয় কিংবা চরম পর্যন্ত ব্যবস্থাপত্র কিন্তু অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের মতোঅন্ধকারে ঢিল ছোড়া। এতে বরফের উপরিখণ্ড চোখে পড়ে, চিকিৎসাও হয় কিন্তু রোগ নির্মূল হয় না।

দুই. তা কেন তার উত্তর খুঁজতে গবেষকদের গবেষণা উদ্ভূত নিবন্ধের অবতারণা। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃতিত্ব এবং এর অনুঘটক কারো অজানা নয়। শুধু সংখ্যা আর অনুপাতের লেন্সে নয়, সাদা চোখে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণেও পরিষ্কার যে অন্তত ভাতের বদলে ফ্যান খাওয়ার দিন গতপ্রায়।  প্রাক-মহামারী প্রায় এক দশকে (২০০৫-২০১৬) দারিদ্র্যের প্রকোপ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে সহনীয় চরম দারিদ্র্য যথাক্রমে ২৪ ১৩ শতাংশ। মোটামুটি গড়পড়তা এক-চতুর্থাংশ মানুষ ওপর দারিদ্র্যরেখার নিচে অবস্থান করছে আর প্রায় ১৩ শতাংশ নিচু রেখার নিচে (২০১৬) তবে একটা অঙ্গ যেমন পুরো শরীর নয়, তেমনি গড়পড়তা হিসাব পুরো দৃশ্য সামনে আনে না।

দরিদ্র সমজাতীয় শ্রেণী নয়, সে অনেক পুরনো কথা। কিন্তু তা নিয়ে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছেন একদল গবেষকজুলফিকার আলি, বদরুন্নেসা আহমেদ, এম মেরিয়ট, জো ডেভাইন জেওফ উড। চরম দারিদ্র্য সম্পর্কে তাদের সুতীক্ষ পর্যবেক্ষণ উপস্থাপিত সুপারিশমালা বিবেচনায় নিলে আখেরে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।

তিন. প্রথমত এবং নিঃসন্দেহে উদ্বেগের উৎসওঅতীতে সহনীয় চরম দারিদ্র্য যে হারে হ্রাস পেত, তার চেয়ে কম হারে কমছে ইদানীং। এই কম হারে কমার ব্যাপারটা চরম দরিদ্রের বেলায় অপেক্ষাকৃত বেশি প্রবল বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়ত, নগরের চেয়ে পল্লীতে চরম দারিদ্র্য হ্রাসের গতি অপেক্ষাকৃত বেশি। হয়তো গ্রামীণ শিল্প সেবায় বহুমুখীকরণ গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস ব্যাখ্যা করে কিন্তু নগরে অপেক্ষাকৃত কম সফলতার ব্যাখ্যা পরিষ্কার নয়। তৃতীয়ত, দারিদ্র্য হ্রাসে সফলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতি চারজনে একজন দরিদ্র, অর্থাৎ প্রায় চার কোটি মানুষ দৈনিক হাজার ১০০ ক্যালরি নিতে পারে না, প্রান্তিক উৎপাদনশীলতায় অনেক পিছিয়ে থেকে জীবন নির্বাহ মজুরিতে পেট চালায়। চতুর্থত, ইদানীং বেশ নজর কাড়ছে শুধু নাক ভাসিয়ে দারিদ্র্যরেখার ওপর অবস্থান নেয়া মানুষগুলো কারিগরি ভাষায় যাকে বলে ভালনারেবল নন পুওর, তারা দরিদ্র নয় কিন্তু সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছেএকটা সুযোগে পেটে ভাত, একটা আঘাতে কুপোকাত। এরা একবার ডুবে আবার ভেসে ওঠে এবং এক্ষেত্রে সহনীয় দরিদ্রগোষ্ঠীর তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ চরম দরিদ্রগোষ্ঠী অধিকতর দ্রুততার সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে অতলান্তে, তা সে নগরের ঘিঞ্জিতে হোক কিংবা গহিন গ্রামে। মাহাবুব হোসেন লেখকের বইতে দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র দারিদ্র্যরেখা বেয়ে উত্তাল সমুদ্রে ছোট ছোট নৌকার মতো নামে আর ওঠে। এদের কথা ইদানীং গুরুত্ব দিয়ে বলছেন . বিনায়ক সেন।

চার. বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের সুখের গল্পটা নির্ভুল, তবে নির্ভাবনার নয়। সুখের তো বটেই, অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায় (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মা নদীর মাঝি); তবে একই সঙ্গে হয়তো উচ্ছ্বাসের কারণে দুঃখের কথা অন্তরালে অন্তরিত হয়।

জুলফিকার আলি অন্যরা জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে স্থানিক বৈষম্য (Spatial disparities) বিশ্লেষণ করে বলছেন, চরম দারিদ্র্যের বেলায় বিস্তর আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রামে মাথা গণনা সূচক দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ, অথচ সবচেয়ে ধনী নারায়ণগঞ্জে হার মাত্র প্রায় শতাংশ। আবার সবচেয়ে দরিদ্র ১০ জেলার মধ্যে সবচেয়ে ধনী লালমনিরহাটে দারিদ্র্যের প্রকোপ ৪২ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। মোট কথা, সবচেয়ে গরিব ১০ জেলার সহনীয় দারিদ্র্য ৪২-৭১ শতাংশ এবং সবচেয়ে ধনী ১০ জেলায় -১১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ জেলায় চরম দারিদ্র্য ৫৪ থেকে ২৪ শতাংশ আর সবচেয়ে ধনী ১০ জেলায় থেকে শূন্য শতাংশ। মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ নারায়ণগঞ্জে গরিব নেই বললেই চলেসার্বিক হার শতাংশের নিচে। লক্ষণীয় আরো যে সবচেয়ে ধনী ১০ জেলায় দারিদ্র্য হারের পার্থক্য বেশ কম কিন্তু সবচেয়ে গরিব ১০ এলাকায় বেশি। তাহলে কি লিও টলস্তয়ের আন্না কারেনি যে রকম বলা হচ্ছে, তা- সত্যধনীরা প্রায় একই রকম; গরিবরা গরিব নিজের মতো করেই এবং সত্য এও যে যেসব জেলায় সহনীয় দরিদ্র বেশি, সেখানে চরম দরিদ্রও বেশি। তুলনীয় সময়ে অর্থাৎ ২০০৫-১৬ সময়ে মাথা গণনা সূচকে ৬৪ জেলার মধ্যে ২৪ জেলায় চরম দারিদ্র্য বেড়েছে; এমনকি বৃদ্ধির হার তাত্পর্যপূর্ণ। সুতরাং বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে এমন অনপেক্ষ অবস্থান অনেকটা ফ্যালাসি অব কম্পোজিশন বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।

আয়ভিত্তিক চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ অধিকতর উত্তর-পশ্চিম, কেন্দ্র-উত্তর দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে। অন্যদিকে আয়বহির্ভূত নির্দেশকে চরম দারিদ্র্য বেশি দক্ষিণ-পূর্ব, কেন্দ্র-উত্তর উত্তর-পূর্ব জেলায়। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য হ্রাস কর্মসূচি দেশব্যাপী একই রকম ছিল না। মোট কথা, দেশব্যাপী দারিদ্র্য গুহা বা পভার্টি পকেট সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রত্যেক পকেটের বৈশিষ্ট্য চালকের পার্থক্যের কারণে প্রকোপের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আরো বিভাজিত বিশ্লেষণসমেত পকেট অনুযায়ী পাওনা মেটালে প্রকোপ প্রশমনের কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা আছে। এটা এও প্রমাণ করে যে জেলাভিত্তিক পর্যালোচনা অধিকতর জটিল দারিদ্র্য জালের কথা বলে এবং জাল সব জেলায় এক নয়।

পাঁচ. জেলা পর্যায়ে আয়বৈষম্যের সঙ্গে চরম দারিদ্র্য স্তরের কোনো সম্পর্ক নেই বলে ধারণা। তার মানে দাঁড়ায়, হয়তো উঁচু স্তরের চরম দারিদ্র্যের জন্য আয় প্রধান চালক (খলনায়ক?) নয়। অর্থাৎ অন্যান্য উপাদান বিবেচনায় নেয়া দরকার। এখন পর্যন্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীভেদে চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ বিশ্লেষিত হয়নি কিন্তু গবেষকরা পেয়েছেন যে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি, যেমন খ্রিস্টান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে চরম দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা মুসলমানদের চেয়ে দ্বিগুণ। খানাপ্রধান নারী হলে চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি হবে। যেমন জাতীয় পর্যায়ে এমন ধারণা নাকচ করা যায় যখন পুরুষের তুলনায় নারীপ্রধানের খানায় প্রকোপ প্রান্তিক কম (উপজেলাভেদে পার্থক্য আছে) তার মানে খানাপ্রধান একজন নারী হওয়ার সুবাদে দারিদ্র্য দুয়ারে এসে হাজির তা নয়, আসলে এই নারী যখন অন্যান্য উপাদানের শিকার হন, যেমন নিম্ন আয় অবস্থান, বিশেষ সম্প্রদায়ের, উঁচু নির্ভরতার হার, পুরুষ অভিভাবকের অভাব ইত্যাদি তাকে ঝুঁকিপূর্ণ অসহায় করে তোলে। অথচ জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত তথ্য এসব বিষয় আমলে নেয় না। আবার খানায় দৈহিক অক্ষম ব্যক্তির উপস্থিতি চরম দরিদ্রের উপস্থিতি সমানে যায়এমন ভাবনা বিভাজিত বিশ্লেষণে বাস্তব নয় বলে মনে করা হচ্ছে।

ধর্ম, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, অসামর্থ্যসহ চরম দারিদ্র্যে দৃষ্টি দেয়ার দুটো তাত্পর্যপূর্ণ দিক রয়েছে। এক. যতই স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য সংগৃহীত হবে ততই চরম দারিদ্র্যের পার্থক্য পরস্ফুিটিত হবে। ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ণয়ে তথা ওয়ান সাইজ ফিটস অল প্রেসক্রিপশন পরিহার করে চরম দারিদ্র্য দূর করা যাবে। দুই. ধর্ম, লিঙ্গ, অসামর্থ্য চরম দারিদ্র্য বিশ্লেষণে বোঝাপড়ায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমআইপি) গবেষকদের উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ। তবে তা দারিদ্র্যের গল্প পাল্টায় না। দুটো স্বাস্থ্য, দুটো শিক্ষা এবং ছয়টি জীবনমান নির্দেশক নিয়ে তৈরি করা সূচকের নিক্তিতে আঞ্চলিক বৈষম্য ধরা পড়েপল্লীর সূচক নগরের সূচকের চেয়ে দ্বিগুণ, যথা সুনামগঞ্জে ৪৮ শতাংশ তো ঢাকায় শতাংশ। শিক্ষার সঙ্গে নেতিবাচক সম্পর্ক দেখায় যে এমনকি চরম দরিদ্রের জন্যও শিক্ষা জিয়নকাঠি হতে পারে। সচ্ছলতার নিরিখে নিচের ১০ শতাংশের এমপিআই ওপরের ১০ শতাংশের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

বঞ্চনার প্রত্যেক বিভাগেই বিকট বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন অপুষ্টিতে পল্লীতে শহরের চেয়ে বেশি বঞ্চনা, শিশুমৃত্যু হারে সিলেট খুলনা সবার ওপরে, অমুসলিম বঞ্চিত মুসলিমের চেয়ে ইত্যাদি। সুতরাং নীতিমালা প্রণয়নে আরো বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তবে () যথাসম্ভব এলাকাভিত্তিক, অসমষ্টিভূত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেয়া উচিত এবং () চরম দারিদ্র্য হ্রাসে শিক্ষা স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, দারিদ্র্য কোনো দুর্ঘটনা নয়; দাসত্ব বর্ণবৈষম্যের মতোই এটা মানবসৃষ্ট মানবকর্মই পারে তা দূর করতে।

 

আব্দুল বায়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক উপাচার্য; বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন