জনবল সংকটে নষ্ট হচ্ছে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ

সুরক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানো হোক

বাংলাদেশ অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী। আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময়ে দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসকশ্রেণী গড়ে তোলে অসংখ্য ইমারত, নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার স্তূপ সমাধি সৌধ। এসব ঐতিহ্যের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাংস্কৃতিক চিহ্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও টিকে আছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর মধ্যেও সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি মাত্র ৫১৮টি, তার মধ্যে আবার গেজেটভুক্ত মাত্র ১৭৮টি নিদর্শন। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনবল সংকটসহ নানা কারণে অধিকাংশই রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যে কয়েকটি নিদর্শন টিকে রয়েছে, সেগুলোও নষ্ট হওয়ার পথে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সক্রিয়তা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

প্রত্নসম্পদ রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংস্থাগুলো বরাবরই বেশ উদাসীন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের উদাসীনতার কারণে অনেক ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। সরকারিভাবে দেশের প্রত্নসম্পদগুলো যেটুকু রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাও যেনতেনভাবে। রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ যেমন থাকে না, তেমনি পর্যাপ্ত জনবলও নেই। দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। প্রত্নসম্পদের গবেষণার জন্য তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না। দেশের প্রত্নসম্পদ রক্ষা করতে হলে সরকারকে এখনই বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে হবে। এখানে অনেক সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে সর্বাগ্রে। সমাধান করতে হবে খুব দ্রুত। কারণ এগুলো রক্ষায় যত দেরি হবে ততই হারিয়ে যেতে থাকবে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য। প্রায় সব স্থাপনাই এখন ধ্বংসের মুখে। দেখার জন্য কোথাও কেউ নেই। অনেকে কারসাজি করে এসব সম্পত্তির জাল দলিলপত্রও তৈরি করে মালিক বনেছেন। রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে জরিপ পরিচালনার যে সুপারিশ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ করেছেন, আমরা সেটি সমর্থন করি। কিন্তু তারও আগে এখনো অবশিষ্ট সুপরিচিত স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে হবে। তালিকা করতে গিয়েই আমাদের যে অভিজ্ঞতা, জরিপ চালাতে গিয়ে আরো সময়ক্ষেপণ হলে অদূরভবিষ্যতে দু-একটি বিখ্যাত স্থাপনা ছাড়া বাকিগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা আশঙ্কা। বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্যগত স্থাপনা যেভাবে জনসাধারণের ঘরকন্নার জন্য ব্যবহার হচ্ছে, তাও বাড়তি বিপদের শঙ্কা জাগায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় নেপাল ভুটানের উদাহরণ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। দেশ দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে রেখে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। বিশ্বব্যাপী তাদের ঐতিহ্য নিদর্শন তুলে ধরতে দূতাবাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না। কয়েক বছর আগেই ভারত সরকার বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে নতুন করে। এর মাধ্যমে তারা বিশ্ব দরবারে সবচেয়ে পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক বলে দাবি করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত দ্বিতীয় পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কিছুই আর নেই। কর্তৃপক্ষ চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নতুন করে চালু করতে পারে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের নাম নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং হবে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শুধু সংরক্ষণ করলেই হবে না, সেটি ব্যবহারের কার্যকর নীতিমালাও থাকা আবশ্যক। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দিলেও সেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। রাজধানী ঢাকা থেকেই গেল দুই দশকে অনেক ঐতিহ্যিক স্থাপনা হারিয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। এটি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে ফ্রান্স ইতালির কথা স্মরণে রাখা যেতে পারে। দেশ দুটির রয়েছে সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তারা এসব সংগ্রহ করে রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ সেগুলো দেখতে সেখানে যাচ্ছে। বাংলাদেশও নিজস্ব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।

দেশে পুরাকীর্তি বিষয়ে তিনটি আইন বিদ্যমান: ট্রেজারস ট্রুভ অ্যাক্ট ১৮৭৮, অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্টস প্রিজারভেশন অ্যাক্ট ১৯০৪ অ্যান্টিকুইটিজ অ্যাক্ট ১৯৪৭ তিনটি আইনই ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত। আইনগুলো পাকিস্তান আমলে হুবহু আত্তীকৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর একই অবস্থায় আইনগুলো কার্যকর হয়েছে। ট্রেজারস ট্রুভ আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রাপ্ত সময় থেকে ১০০ বছরের পুরনো মাটির নিচে থাকা যেকোনো বস্তু পাওয়ামাত্র নিকটতম ট্রেজারিতে জমা করতে প্রাপক বাধ্য থাকবে। আইনটি ১৮৯১ ১৯০৭ সালে কিছু সংশোধন করা হয়। নানা কৌণিকে ব্যাখ্যা করে আইনটির সংস্কার খুবই প্রয়োজন। অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্টস প্রিজারভেশন অ্যাক্ট পুরাকীর্তির পাচার রোধ এবং ঐতিহাসিক ইমারত রক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক শিল্পকলার নিদর্শনগুলো সংগ্রহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতার কারণে নিদর্শনগুলো একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইনেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। সরকার প্রত্নসম্পদ রক্ষায় অধিদপ্তর গঠন করেছে। কিন্তু এর জনবল অর্থ কোনোটিই যথাযথভাবে দেয়া হয়নি। ফলে স্বল্প জনবল স্বল্প অর্থ নিয়ে বিপুল প্রত্ননিদর্শন রক্ষা করা কঠিন। তার পরও যতটুকু প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল, তাও দৃশ্যমান নয়। দুই দশকে মাত্র ১৭৮টি নিদর্শন গেজেটভুক্ত করা হতাশাজনক।

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে হলে প্রয়োজন একটি কমিশন তৈরি করে সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়ন। প্রণীতব্য নীতিমালার মাধ্যমেই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষায় আইনগুলো সংস্কার করে হালনাগাদ করা সম্ভব। এসব কাজ যত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। প্রত্নসম্পদ রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংস্থাগুলো বরাবরই বেশ উদাসীন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের উদাসীনতার কারণে আমরা নিজস্ব অনেক ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছি। সরকারিভাবে দেশের প্রত্নসম্পদগুলো যেটুকু রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাও যেনতেনভাবে। রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ যেমন থাকে না, তেমনি পর্যাপ্ত জনবলও নেই। দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। আরেকটা বিষয় আমাদের এখানে ঘটে, তা হলো প্রত্নসম্পদের গবেষণার জন্য তেমন সুযোগ না দেয়া। দেশের প্রত্নসম্পদ রক্ষা করতে হলে সরকারকে এখনই বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে হবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রত্যেক জাতির জন্যই অমূল্য সম্পদ। সম্পদ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। অথচ আমাদের দেশের এই মূল্যবান নিদর্শন সংরক্ষণের যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামো প্রত্ননিদর্শন। এগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কাজটি করে জাদুঘরগুলো। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন গবেষণার জন্য যে জাদুঘর আমাদের রয়েছে, সেগুলো এখনো উনিশ শতকে পড়ে আছে। এগুলোকে প্রকৃত অর্থে জাদুঘর বলা যায় না। কারণ এগুলো কেবল সারিবদ্ধভাবে নিদর্শনগুলো প্রদর্শনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের কাজ। কিন্তু জাদুঘরকে আরো বেশি জনগণসম্পৃক্ত করতে হবে। নতুন নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জাদুঘরগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক এসব অমূল্য নিদর্শন অচিরেই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। তাই বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার এখনই সময়। সেজন্য জনসাধারণকে সচেতন সম্পৃক্তকরণ, প্রত্নবস্তু সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট আইনকে যুগোপযোগী করা, পেশাজীবী দক্ষ জনবল তৈরি করা, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে কাজ করা যেতে পারে। সর্বোপরি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায় সংরক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। আমরা চাই অবিলম্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং পূর্ণাঙ্গ জরিপ তালিকা করা। একই সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে আরো সক্রিয় হতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন