বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতায় চীনই জয়ী কি

বণিক বার্তা ডেস্ক

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি বঙ্গোপসাগরের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। একই কথা প্রযোজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রেও। শুধু আঞ্চলিক নয়, ভূরাজনীতির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। সাগর-তীরবর্তী দেশগুলোর জনসংখ্যা দেড়শ কোটির কাছাকাছি। বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যে পরিবাহিত পণ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশই যায় বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে। ইন্দো-প্যাসিফিকের উপ-অঞ্চলটির কৌশলগত অর্থনৈতিক তাত্পর্য বিবেচনায় গত কয়েক বছরে এখানকার দেশগুলোর মধ্যে কানেক্টিভিটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একের পর এক প্রকল্প নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন ভারত। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈরী দুই দেশের দ্বৈরথে এখন চীনকেই এগিয়ে রাখছেন পর্যবেক্ষকরা।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠলেও এখনো বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে কানেক্টিভিটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যদিও বর্তমানে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রভাবের বড় একটি মাপকাঠি হয়ে উঠেছে আর্থিক, জ্বালানি এবং সড়ক-রেল-আকাশ নৌ কানেক্টিভিটি। অঞ্চলভুক্ত না হলেও বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে বড় আয়তনের সীমান্ত রয়েছে চীনের। এসব দেশে অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুশাসন পরিচালনগত অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও চেকবুক ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে চীন তা ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আয়তন, জনসংখ্যা অর্থনীতির আকারের কারণে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী দেশগুলোর ভূরাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান ভারতের। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এখানকার আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ দিনে দিনে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বেইজিংয়ের প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে দেশ দুটির অবদানই বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা থাইল্যান্ডের সঙ্গে কানেক্টিভিটি তৈরিতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ভারত। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে এসব দেশের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত কানেক্টিভিটি গড়ে তুলতে যোগাযোগ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে চীন।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় অ্যাক্ট ইস্ট (পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়ানো) নীতিমালা গ্রহণ করেছিল ভারত। ২০১৪ সাল থেকেই নিজ সীমান্তের পূর্বদিকে সক্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। আঞ্চলিক সক্রিয়তার দিক থেকে দেশটির মনোযোগও দক্ষিণ এশিয়া থেকে সরে আসে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সার্কের পরিবর্তে বিমসটেক জোটে ক্রমেই সক্রিয় হয়ে ওঠে ভারত। ভূরাজনৈতিক সক্রিয়তার ভরকেন্দ্র বদলালেও বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কানেক্টিভিটি উন্নয়নে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ভারত। অন্যদিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় দেশগুলোয় একের পর এক সড়ক-রেল-নৌ আকাশ চলাচল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে চীন। সক্রিয়তা বাড়িয়েছে আর্থিক এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতেও।

বঙ্গোপসাগরে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় চীনকেই বিজয়ী হিসেবে দেখছেন ভারতীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা মুম্বাইভিত্তিক গেটওয়ে হাউজের এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের ফেলো অমিত ভান্ডারি। আনফিনিশড কানেক্টিভিটি ইন বে অব বেঙ্গল শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে সম্প্রতি তিনি লিখেছেন, বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোয় কানেক্টিভিটির মাধ্যমে স্বার্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই জয় চীনেরই হয়েছে। কৌশলগত পরিকল্পনাবড় আকারের বিনিয়োগ এবং উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে বিজয় আদায় করে নিয়েছে চীন। রেল থেকে শুরু করে সড়ক বা বন্দর অবকাঠামো হোক, বেইজিংয়ের প্রকল্পগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কুনমিং থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশ হয়ে প্রস্তাবিত হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনের কথা। এছাড়া অঞ্চলে নৌ অবকাঠামোতেও বড় বিনিয়োগ করে চলেছে চীন। যদিও এসব অবকাঠামো থেকে দেশটি ছাড়া অন্যদের লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। যেমন শ্রীলংকার হাম্বানটোটা, মিয়ানমারের কিয়াউকপিউ থাইল্যান্ডের ক্রা ক্যানেলের মতো প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য শ্বেতহস্তী হয়ে উঠেছে।

তিনি আরো বলেন, অন্যদিকে ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল মিয়ানমারের সঙ্গে সফলভাবে আন্তঃসীমান্ত সড়ক রেল অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। যদিও এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রায় সবই আয়তন সম্ভাবনার দিক থেকে অনেক ছোট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্প বাংলাদেশ বা নেপালের বিদ্যমান রেল বা সড়ক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ মাত্র। কিন্তু এখানে বাংলাদেশ নেপালের মধ্যে সরাসরি রেল, বন্দর বা বিদ্যুতের কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার মতো উচ্চাভিলাষী কোনো পরিকল্পনা নেই। চীনের বিনিয়োগকে যতটাই ভীতির চোখে দেখা হোক না কেন, দেশটির চেক বই কূটনীতিকে ঠেকাতে এখনো সক্ষম হয়ে ওঠেনি ভারত। আর এরই ধারাবাহিকতায় অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে চীন।

অমিত ভান্ডারি প্রণীত কৌশলগত গবেষণাপত্র সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া সরকারের অর্থায়নে প্রকাশিত হয়েছে।

আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি নিয়ে পরিকল্পনা দৃষ্টিভঙ্গিও বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নয়াদিল্লিকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, বিষয়ে নয়াদিল্লির মনোযোগ অনেকটাই দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করার দিকেই নিবদ্ধ। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক নৌ-সংযোগ ব্যবস্থায় আরো বেশি বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এলে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এতটা পিছিয়ে থাকত না দেশটি। এমনকি এখন পর্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা আন্দামান নিকোবরের সম্ভাবনাগুলোকে পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে পারেনি নয়াদিল্লি।

বৃহৎ আয়তন, অর্থনীতি জনসংখ্যার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আবর্তিত হয় মূলত ভারতকে কেন্দ্র করে। কারণে দেশটির অংশগ্রহণ ছাড়া এখানকার আঞ্চলিক আন্তঃসীমান্ত কানেক্টিভিটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলে পর্যন্ত অনেক বিশেষজ্ঞই অভিমত দিয়েছেন। তবে আর্থিক সক্ষমতার দিক থেকে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এখনো অনেক পিছিয়ে ভারত। বৃহদায়তনের কানেক্টিভিটি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশটিকে প্রায়ই তৃতীয় কোনো অংশীদারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কয়েক বছর ধরে দেশটির অর্থনীতির পারফরম্যান্সও খুব একটা ভালো ছিল না। কভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপজনিত অর্থনৈতিক মানবিক বিপর্যয় দেশটির অর্থনৈতিক দুর্বিপাককে আরো জোরালো করে তুলেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন