অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে টিফা চুক্তি কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া

মেসবাহুল হক

দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়াতে সম্প্রতি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া। বাণিজ্য বিনিয়োগসংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা (টিফা) শীর্ষক ওই চুক্তি কাজে লাগিয়ে করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাজ করতে চায় উভয় দেশ। এরই অংশ হিসেবে আগামী বছরের প্রথমার্ধেই অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা। সভায় ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। বাণিজ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে আগামী বছরের প্রথমার্ধে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা। সভায় বাংলাদেশের পক্ষে অংশগ্রহণের জন্য ২৫ নভেম্বর ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতিনিধি দলের দলনেতা করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মো. হাফিজুর রহমানকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব একজন উপসচিব, একই মন্ত্রণালয়ের এফটিএ অনুবিভাগ ডব্লিউটিও সেলের একজন করে প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিনিধি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিকেও দলে রাখা হয়েছে।

অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটার মেরিস পেইন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেনকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে কভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে টিফা চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরালো করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিফা শুধু দুই দেশের বাণিজ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রভিত্তিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরো জোরালো হবে বলে আশা করছে অস্ট্রেলিয়া, যা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করা যাচ্ছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, যখন দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়াসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আশাবাদী হচ্ছি, ঠিক তখনই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা, এনার্জি খাতে বাণিজ্য বাড়ানোর খুব সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য পণ্য এবং সেবা খাতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এসব নতুন নতুন খাত নিয়ে আগামীতে উভয় দেশে কাজ করতে আগ্রহী বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য গত সেপ্টেম্বরে টিফা স্বাক্ষরিত হয়েছে। ওই ফ্রেমওয়ার্ক বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা ধরে রাখা, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং বাণিজ্য বিনিয়োগের প্রবাহ বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিসহ সব প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কাজ করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রসার এবং তা আরো গতিশীল করতে কাজ করে যাচ্ছে। চুক্তির আওতায় তা আরো বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজি পেপার তৈরি করেছে। হাইকমিশনের কৌশলপত্রে দেখা গেছে, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তার পরও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় বিনিয়োগের পরিমাণ সন্তোষজনক নয়। তাই অস্ট্রেলীয় উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ সম্মেলন, রোড শো করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কৌশলপত্রে দেখা গেছে, গত ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ীরা ভারতে হাজার ৪৭৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে। ফিলিপাইনে একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫৫ কোটি ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৭৯২ কোটি ডলার, থাইল্যান্ডে ৫৩০ কোটি ডলার আর ভিয়েতনামে ২৩০ কোটি ডলার। সেখানে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। 

প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত এক চিঠিতে বিডা জানায়, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ়। বিশেষ করে ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে দেশটির বাজারে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত রফতানি সুবিধা ভোগ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও প্রায় ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। তার পরও এশিয়ার অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম।

বাংলাদেশ নিম্ন আয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির দেশে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ রফতানিতে বিচিত্রতায় অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে শিল্পায়নের অপরিসীম গুরুত্ব। তাই দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে আকর্ষণের মাধ্যমে শিল্পায়নের প্রসারে বিডা কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান বিনিয়োগ আকর্ষণে বিডা চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ সম্মেলন, রোড শো আয়োজন করবে। এজন্য অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কৌশলপত্র অনুযায়ী যেসব খাতে সে দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী, সেসব পণ্যে বিশেষ করে তৈরি পোশাক, লাইন ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ফার্নিচার, প্লাস্টিক পণ্য এবং খেলনাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাস্তবতা পর্যালোচনায় সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একাধিক সভা করা হয়েছে।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আগামীতে অস্ট্রেলিয়ায় যে বিনিয়োগ রোড শোর আয়োজন করা হবে, সেখানে অস্ট্রেলীয় উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে অবহিত করা হবে। সাম্প্রতিককালে, বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি বিনিয়োগে একটি সহায়ক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিয়োগ নীতির ক্ষেত্রে বেশকিছু পুরনো ব্যবস্থা সংস্কার করেছে। এসব বিষয় সেখানে তুলে ধরা হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ পরিবেশ বিরাজ করছে তা অনেক দেশ এখনো জানে না। তাই আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন