চলতি সময়

করোনাকালে ই-হেলথের উত্থান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

হুমায়ুন কবির

গত দুই দশকে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিসরে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার গৃহীত রূপকল্পে বেগবান হয়েছে ডিজিটালাইজেশন। নানা ক্ষেত্রে এর সুফল আজ দৃশ্যমান। ডিজিটালাইজেশনের ফলে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা প্রসার লাভ করেছে। খাদ্য সরবরাহ, রাইড শেয়ারিং থেকে শুরু করে অর্থ লেনদেন অনেক সহজ হয়েছে। একইভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। ডিজিটাল পরিকাঠামো সূত্রে বিকাশ লাভ করা -হেলথ বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করছে। ফলে বেশ দূরবর্তী এলাকা থেকে এসে রোগীকে আর চিকিৎসক দেখাতে হচ্ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না। রোগীসহ আত্মীয়-পরিজনের সময় সাশ্রয় হচ্ছে অনেক। সঙ্গে বাঁচছে উচ্চ পরিবহন ভ্রমণ ব্যয়ও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার ঝক্কি এড়াতে আগে প্রায় ৫৮ শতাংশ রোগীই স্থানীয় ওষুধ বিক্রেতা, হোমিওপ্যাথ, হাকিমের মতো হাতুড়ে ব্যক্তিদের পরামর্শ নিত। -হেলথের আবির্ভাবে হার বর্তমানে অনেকাংশে কমে এসেছে। জনগণের মানসম্পন্ন, সাশ্রয়ী, ঝামেলাহীন চিকিৎসাসেবা জোগাতে এটা বড় উল্লম্ফন বৈকি।

-হেলথ শুধু টেলিমেডিসিনের ব্যাপার নয়, এটা ডিজিটাল প্লাটফর্ম, ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড ব্যবস্থা, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা (এম-হেলথ) জরুরি ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তাসহ অনেক কিছু ধারণ করে। দেশে -হেলথের যাত্রা মূলত ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝিতে; যখন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সুইনফেন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামের এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান মোবাইলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান প্রবর্তন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ধরনের উদ্যোগ বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালের দিকে এসে গ্রামীণফোন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি যৌথভাবে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের জন্য টেলিমেডিসিনের উদ্যোগ নেয়। ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে ঢাকায় বারডেমের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালটির রোগীদের সংযুক্ত করে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, কিছু কারিগরি লজিস্টিক ইস্যুর কারণে ভালো উদ্যোগটি খুব একটা সফল হয়নি। তবে ব্যাপকতর ডিজিটালাইজেশন দেশে টেলিকম খাতের প্রসারে ধীরে ধীরে -হেলথ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বিশেষ করে করোনা অতিমারীতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ভয়াবহ সংকটের মধ্যে -হেলথের প্রসার নতুন গতি পায়। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার অল্প সময়েই ভেঙে পড়ে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা। একদিকে হাসপাতালে যেতে রোগীদের সংক্রমণ আতঙ্ক, অন্যদিকে চিকিৎসা পেতে করোনা নেগেটিভ সনদ দেখানোর বিধি জারি করে অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সব ধরনের রোগী। চিকিৎসা সংকটে পড়েন সন্তানসম্ভবা নারী, ডায়াবেটিস, কিডনি বা হূদরোগীর মতো নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা মানুষগুলো। এমন দুঃসময়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তে আলোর রেখা হিসেবে ত্রাতার ভূমিকায় আসে -হেলথ। আরো বড় কলেবরে চালু হয় টেলিমেডিসিন সেবা। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের আত্মপ্রকাশ ঘটে ধরনের সেবায়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। হোয়াটসআপ, ইমো, ভাইবার, স্কাইপে ব্যবহার করে রোগী দেখা শুরু করেন চিকিৎসকরা। প্রায় দুই বছরের অভ্যস্ততায় এখন এটা অনেকটা স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে।

সময়ান্তরে ক্রমেই বাড়ছে -হেলথের চাহিদা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান বর্ধমান চাহিদা মেটাতে -হেলথ সেবা প্রদানে এগিয়ে আসছেন নতুন উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগকারীরা -হেলথকে বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র মনে করছেন। এক গবেষণা জরিপ বলছে, ৬৭ শতাংশ বিনিয়োগকারীই তাদের বিনিয়োগের প্রাধিকার তালিকার তৃতীয় অবস্থানে রাখছেন খাতকে। বর্তমানে সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩, জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩- আইইডিসিআরের হটলাইন ১০৬৫৫ থেকে টেলিফোনে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। করোনাকালে মা শিশুদের ঘরে বসে চিকিৎসাসেবা দিতে সরকার চালু করেছে মা টেলিহেলথ (০৯৬৬৬৮৮৮৮৮৮) এছাড়া প্রাভাহেলথ, লাইফস্প্রিং, অর্ক হেলথ লিমিটেড, সিনেসিস হেলথ, ডিজিটাল হেলথ, প্রবাসী হেল্পলাইন, হিউম্যান হেলথ হেল্পলাইন, ডিজিটাল হেলথকেয়ার ফাউন্ডেশন, কুইকমেড, জীয়ন, বেস্ট এইড, মায়া, ডাক্তার দেখাও, ডক্টরোলা, ডাক্তারকই, মনের বন্ধু, ক্লিক এন কেয়ার, যত্ন, আস্ক ডক্টর, মেডিসিন ক্লাব, ডাক্তার বাড়িসহ বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান -হেলথ সেবা দিচ্ছে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরও গ্রাহকদের জন্য চালু করেছে টেলিমেডিসিন সেবা। রবি আজিয়াটা গ্রাহকদের জন্য যেমন রয়েছে হেলথ প্লাস, বাংলালিংক গ্রাহকদের জন্য রয়েছে ডাক্তারভাই, গ্রামীণফোন গ্রাহকদের জন্য রয়েছে টনিক

তবে -হেলথের স্থায়িত্বশীল রূপান্তরের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল সিগন্যাল থাকলেও এলাকাভেদে গতিতে রয়েছে ভিন্নতা। ফলে মোবাইল ব্যবহার করে দূরবর্তী প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়া বেশ দুষ্কর। আবার গ্রামের অধিকাংশ মানুষের হাতে মোবাইল থাকলেও অনেকেরই নেই স্মার্টফোন। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের হেলথ-টেক সেবা পাওয়া ব্যাহত হচ্ছে। অবশ্য স্মার্টফোন থাকলেও উচ্চ ডাটা ফি, অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি এবং দুর্বল আইসিটি অবকাঠামোও যথাযথ চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তদুপরি গ্রামের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষেরই ইন্টারনেট সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান নেই। শুধু ইন্টারনেট নয়, অনেকেই মোবাইলও ব্যবহার করতে জানে না। ফলে ইন্টারনেট সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে বিশেষ করে নারী বয়স্ক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যাদের তা ভীষণ প্রয়োজন। সমরূপভাবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের দিক থেকেও কিছু ঘাটতি আছে। ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ, ব্যয়সাধ্য এবং তাতে বিপুল প্রচেষ্টা দরকার হওয়ায় অনেক হাসপাতালের প্রশাসন ওই পথে যেতে চায় না। এখানে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কেরও একটা বিষয় রয়েছে। চিকিৎসকের শারীরিক উপস্থিতি রোগীদের সমস্যা, ব্যথা-বেদনা প্রকাশে সাহায্য করে; বিপরীতে চিকিৎসকও সহানুভূতি, সহমর্মিতা জানিয়ে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারেন। শারীরিক মিথস্ক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে -হেলথ সেবায় রোগীর আস্থা সন্তুষ্টি অর্জন কঠিন। আছে নিরাপত্তার সংকটও। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করলেও সেখানে টেলিমেডিসিন বা -হেলথের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। মেডিকেল ডাটা সাধারণত খুব স্পর্শকাতর গোপনীয়। কাজেই সেগুলোর নিরাপত্তা বিধান অতিজরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে ঘাটতি বিদ্যমান। এগুলো কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া বিদ্যমান সেবা নিয়ে হয়রানির অভিযোগও কম নয়। অধিকাংশ জেলা হাসপাতাল উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে টেলিমেডিসিন সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করেও চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওয়েব ক্যাম ল্যাপটপ বিকল হয়ে বন্ধ রয়েছে অনেক সরকারি হাসপাতালের টেলিমেডিসিন কার্যক্রম। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ না করিয়ে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে ঢের। এগুলো দূর না করলে -হেলথ খাতের টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়।

উন্নত বিশ্বে -হেলথ আগে থেকেই একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেছে। করোনায় দেশগুলো ভালোভাবে এটিকে কাজে লাগাতে পেরেছে। বিশেষ করে এশিয়ায় সিঙ্গাপুর, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানে -হেলথের সুফল নিশ্চিতের বিষয়টি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা পাকিস্তান সীমিত সাধ্যের মধ্যে -হেলথকে  অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে, করোনাকালে কাজে লাগিয়েছে। অনলাইন পরিকাঠামো গড়ে তুলে এর প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছে। পরিপূরক নীতি নিচ্ছে। বিনির্মাণ করছে সহায়ক ইকোসিস্টেম। অন্য দেশের নীতি, পদক্ষেপ কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের জন্য -হেলথের রূপান্তরে সহায়ক হবে।

বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। এখানে মানুষ অনুপাতে চিকিৎসক অপর্যাপ্ত। বিশেষায়িত চিকিৎসকরা আবার শহরকেন্দ্রিক। ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দিতে পারলে অনেক দিক থেকে লাভ। এতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ অনেক কমবে। মানুষের ভোগান্তিও কমবে। কাজেই -হেলথকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। প্রথমত, এটাকে আরো ফলপ্রসূ করতে একটা গাইডলাইন প্রয়োজন। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিবন্ধিত চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে। রোগীর ইলেকট্রনিক হেলথ ডাটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে চিকিৎসা অনেক সহজ হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসার তথ্যও থাকতে হবে। তবে স্পর্শকাতর হওয়ায় তথ্য কারা দেখতে পারবে তারও একটা নীতি থাকা জরুরি। বিভিন্ন দেশে ধরনের নীতি রয়েছে।

করোনাকালে দেশে -হেলথের কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে। এর পরে যে মহামারী আসবে না কিংবা করোনার নতুন ধরন (এখন যেমন ওমিক্রন দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে) আরো ভয়ংকর হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। কাজেই ভবিষ্যতে মহামারীর মতো দুর্বিপাক মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। -হেলথের পরিপূরক ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে নিতে হবে গঠনমূলক অ্যাপ্রোচ। নতুন করে অনেকেই -হেলথ খাতে আসতে চাইছে। খাতের স্টার্টআপগুলোর জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান জনবলকে আরো প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিতে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ভালো আইটি সুবিধা অবকাঠামো বাড়াতে হবে। হেলথ রেকর্ডস ব্যবস্থারও অধিকতর উন্নয়ন জরুরি। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সেবা প্রবর্তন করতে হবে, যেহেতু বাকি জনগোষ্ঠীর মতো তারা খুব একটা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ নন। সরকার ব্যক্তি খাত সমন্বিতভাবে কাজ করলে বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহার করে একটা কার্যকর -হেলথ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।

 

হুমায়ুন কবির: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন