অভিবাসী প্রেরণে বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ

জনশক্তি রফতানির গতি ধরে রাখতে শ্রমদক্ষতা বাড়াতে হবে

বিশ্বে অভিবাসী প্রেরণকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ষষ্ঠ। কিন্তু সে তুলনায় রেমিট্যান্সপ্রবাহ যথেষ্ট কমই বলা যায়, যার অন্যতম কারণ অদক্ষ জনশক্তি প্রেরণ। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশিই অদক্ষ। বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরণ বাড়লেও তাদের অধিকাংশই অদক্ষ বা আধা দক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবে তারা বিদেশ থেকে বড় অংকের অর্থ উপার্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ ফিলিপাইনের মতো দেশ বাংলাদেশের চেয়েও অর্ধেক অভিবাসী শ্রমিক দিয়ে আমাদের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করছেন। বাংলাদেশকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি এখনো গুটিকয়েক দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় বাংলাদেশ থেকে বেশিসংখ্যক জনশক্তি রফতানি হয়। সন্দেহ নেই, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় জনশক্তি রফতানি বাড়ানো গেলে খাতের আয় অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় জনশক্তি রফতানির সুযোগ রয়েছে। আগামীতে বিশেষ করে মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়বে। সেই চাহিদা পূরণে বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানি নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। শুধু নিশ্চিত বিনিয়োগ নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবেও জনসংখ্যা রফতানিকে বিবেচনা করা যায়। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানির যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পারিশ্রমিক যাতে কাজ দক্ষতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সেজন্যও সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল শ্রীলংকা পৃথিবীর অনেক দেশেই কর্মী সরবরাহ করার মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, তা তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। এতে অভিবাসী কর্মীদের পরিবারে যেমন ফিরে এসেছে সচ্ছলতা, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও উন্নয়নের প্রভাব পড়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নতুন সম্পদ অর্জন স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই রকমের চিত্র পাওয়া যায়। তার পরও বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল রেমিট্যান্স আসছে, যার অধিকাংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। এর অন্যতম কারণ আইনের সীমাবদ্ধতা। নির্দিষ্ট পরিমাণের অতিরিক্ত রেমিট্যান্স পাঠানো যায় না বলে অভিবাসীরা বিকল্প প্রক্রিয়া বেছে নিচ্ছেন। রেমিট্যান্স পাঠানোর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের কোনো যৌক্তিকতা বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় আছে বলে মনে হয় না। বিদ্যমান নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ শতাংশ মাত্র অতিদক্ষ। যে কারণে এসব কর্মীর মজুরিও কম। তাই মানবসম্পদকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে হলে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সব ধরনের টেকনিক্যাল বা কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ প্রদান পদ্ধতি তথা সার্টিফিকেট যেন লেবার রিসিভিং কান্ট্রিগুলো আস্থায় নেয়। তা না হলে উন্নত দেশগুলোয় ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা থাকলেও তারা বাংলাদেশ থেকে ধরনের জনশক্তি নেবে না। তাই বিষয়টির প্রতি অধিকতর নজর দিয়ে এবং বিশ্ব চাহিদা মান অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোসহ প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্প্রতি জাপানসহ ইউরোপের কিছু দেশে জনশক্তি পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি কাজে লাগাতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। সারা বিশ্বে এখন দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপদ, সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন নিশ্চিত করা। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তত্পরতা আরো জোরদার করতে হবে।

বন্ধ থাকা জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিনা খরচে নারী কর্মী প্রেরণ সম্ভব হয়েছে সরকারের সক্রিয়তায়। আবার সৌদি আরব, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার উন্মুক্ত করা গেছে। জিটুজির আওতায় জাপান, কোরিয়া মালয়েশিয়ায় খুবই স্বল্প ব্যয়ে কর্মী পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। চীন, হংকং, রাশিয়াসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশে নতুন করে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের ২৯টি দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে লেবার অ্যাটাশে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। মালয়েশিয়ায় অনিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনের দায়ে গত বছর যে গ্রেফতার শুরু হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এর বাইরে আরো অনেক ছোট সাফল্য রয়েছে। তবে এও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই নেগোসিয়েশন ঠিকমতো করতে না পারায় ভালো ফল আসেনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হতাশার অভিবাসন খরচ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন খরচ বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকরা তার কর্মপরিবেশে মারাত্মকভাবে মানসিক চাপে থাকেন; যা নিরাপদ অভিবাসন বিঘ্নিত করছে। এখনো ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের কর্মী অভিবাসন খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। ফলে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক তরুণ যুবকদের বেশির ভাগেরই হয় ঋণ করতে হয়, না-হয় সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। এদিকে জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে খুবই স্বল্প খরচে কর্মী পাঠানোর উদাহরণ থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে তার কার্যকর প্রতিফলন নেই। অন্যান্য দেশেও আগের মতোই অভিবাসন ব্যয় বেড়েই চলেছে। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে আগের তুলনায় নারী কর্মী গমন বৃদ্ধি পেলেও তাদের বেতন বৃদ্ধি সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকর কৌশল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারাটাও বাংলাদেশের বড় সীমাবদ্ধতা।

বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে রেমিট্যান্স আয় আরো বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। জনশক্তি রফতানি খাতটি এখনো বলতে গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের প্রাধান্যে বিদেশ গমনকারীদের যেমন বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনি নানাভাবে প্রতারিত হতে হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় বিদেশে জনশক্তি রফতানি করা গেলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থায় জনশক্তি রফতানি খাত ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক মহীরুহ। কিন্তু খাতের সম্ভাবনাকে এখনো পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পরিকল্পিতভাবে জনশক্তি রফতানি খাতের সমস্যা সমাধান এবং পেশাজীবী দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা গেলে খাত দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারে।

অভিবাসী কর্মীরা, বিশেষ করে স্বল্প দক্ষ কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্ত। অভিবাসী কর্মীরা স্বদেশ প্রবাসে শোষণ, নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা প্রদানে আইনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। তবে এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ থেকে বহির্মুখী শ্রম অভিবাসন বৃদ্ধির অব্যাহত ধারার কারণে শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি বহির্গামী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিবাসী কর্মীদের নিপীড়ন তাদের নিয়োগ-চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে বিবেচনায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অভিবাসীদের সুরক্ষা দুই লক্ষ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে ভবিষ্যৎ শ্রম অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণ কর্মসূচি পরিকল্পনা করার মূল চ্যালেঞ্জ।

নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য অভিবাসী কূটনীতি জোরদার করতে হবে। শুধু নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করলেই হবে না, একই সঙ্গে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ দক্ষ শ্রমিক প্রেরণকে অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শ্রম অভিবাসন খাতই হবে আমাদের অন্যতম এক হাতিয়ার। খাতকে এগিয়ে নিতে হলে নিরাপদ অভিবাসন আর অভিবাসন কূটনীতিকে সমান্তরাল এগিয়ে নিতে হবে। বিশ্ব চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে যেখানে সবাই আশঙ্কা করেছিল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়বে, সেখানে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে বাংলাদেশ সেই ধাক্কা অনেকটা ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে হারটা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। সরকারকে বিষয়গুলো কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন