বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট-২০২১

ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় ১৪ সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত তিন দশকের ব্যবধানে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় আর্থসামাজিক অর্থনৈতিক ১৪টি সূচকে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। জাতীয় আয়ে উৎপাদন খাতের অবদান বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে নারী অগ্রগতি নগরায়ণসহ নানা সুবিধার কারণে অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বৈষম্য বৃদ্ধি সুশাসনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া টেকসই উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়াতে পারে। টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা, কার্যকর রাজস্ব মুদ্রানীতির সমন্বয় প্রয়োজন। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে বার্ষিক বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট-২০২১ (এবিসিডি): সেলিব্রিটিং ৫০ ইয়ার্স অব বাংলাদেশ শীর্ষক সম্মেলনে এসব বিষয় উঠে আসে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আয়োজনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা . মসিউর রহমান। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক . নুরুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বিভিন্ন অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট . জাহিদ হোসেন, আলস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর . এসআর ওসমানি। আয়োজনের গণমাধ্যম সহযোগী ছিল বণিক বার্তা।

উদ্বোধনী সেশনে বাংলাদেশ ইন কমপারেটিভ পারসপেক্টিভ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএস মহাপরিচালক . বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক আর্থসামাজিক ১৬টি সূচকে পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি সূচকে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাকি ১৪টি সূচকে  ভারতের চেয়ে এগিয়ে। অন্যদিকে ১৬টি সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মতো এখন আর বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য নেই। যেমনটি ভারত পাকিস্তানে দেখা যায়। ভারতের তামিলনাডু, কর্নাটক, কেরালা যেভাবে এগিয়ে গেছে, উত্তর প্রদেশ বিহার সেভাবে এগিয়ে যায়নি। একইভাবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে যে উন্নয়ন হয়েছে, তেমন উন্নয়ন হয়নি বেলুচিস্তানে। বাংলাদেশে কোনো অঞ্চলের মধ্যে এমন প্রকট বৈষম্য নেই।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে কী ভূমিকা রেখেছে জানতে চাইলে . বিনায়ক সেন বলেন, গত তিন দশকে বাংলাদেশের উৎপাদন খাত শুধুই এগিয়েছে। অন্যদিকে ভারত পাকিস্তানে সেটি ক্রমেই কমছে। খাতে ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুটি দেশকে পেছনে ফেলার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি বৃদ্ধি। তিন দশকের বেশি সময় ধরে নারীর ক্ষমতায়ন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ এখন নগরায়ণের সুবিধা পাচ্ছে। ফলে নগরায়ণেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জনপ্রতি জিএনআই, আয়ুষ্কাল, শিক্ষার হার, বয়স্ক শিক্ষার হার, মাতৃমৃত্যু হার, পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার, দারিদ্র্যের হার, খর্বাকৃতি, নারীদের প্রাথমিক মাধ্যমিক শিক্ষার হার, উৎপাদনশীল খাতে মূল্য সংযোজন (জিডিপির শতাংশ), রফতানি মূল্য (জিডিপির শতাংশ) গিনি ইনডেক্সসহ নানা সূচকের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এসব সূচকে বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের প্রত্যাশিত মানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, কেবল রফতানি দারিদ্র্যের হারে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্য সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অর্জন বেশ ভালো।

গবেষণায় ১৬টি সূচকে তিনটি দেশের বিভিন্ন সময়ের বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিএনআই দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে বাড়ত, যা এখন দশমিক শূন্য শতাংশ হারে বাড়ছে। একই সময়ে ভারতে বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ২৬ শতাংশ, যা এখন কমে দশমিক ১৪ শতাংশ হয়েছে। একইভাবে ৯০ দশকে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিএনআই ছিল দশমিক ৬৯ শতাংশ, এখন তা আরো কমে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে ৯০ দশকে পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অথচ এখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু আয়ে ১০ শতাংশ এগিয়ে রয়েছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে উৎপাদনশীল খাতে। বাংলাদেশে ৯০-এর দশকে মোট জিডিপিতে উৎপাদনশীল খাতের অবদান ছিল ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এখন তা প্রায় ১৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভারতে ১৬ দশমিক শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পাকিস্তানেও খাতের অবদান ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশে। নগরায়ণেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৯০ দশকে বাংলাদেশের নগরায়ণ হার ছিল ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। ভারতে একই সময়ে নগরায়ণের হার ছিল ২৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা এখন ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। পাকিস্তানের নগরায়ণে সেভাবে অগ্রগতি নেই। ৯০ দশকে পাকিস্তানে নগরায়ণ হার ছিল ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, যা এখন হয়েছে ৩৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। ৯০ দশকে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারী উপস্থিতির হার ছিল ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অথচ এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৩৭ শতাংশে। একই সময়ে ভারতে নারীর উপস্থিতি ছিল ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ২০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে ৯০ দশকে পাকিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল ১৪ দশমিক শতাংশ, এখন এটি ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে। গত এক দশক ছিল গেম চেঞ্জার। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময় নানা ধরনের তদবির অনুরোধ আসে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, সেগুলো যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রকল্পগুলো যদি গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন, কমিউনিটি ক্লাব, হাওর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিতে সুপারিশ করা হয়, তাহলে আমরা সেগুলো গ্রহণ করি। বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, এসব কারণেই বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য স্যানিটারি সেবা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল করা হয়েছে। যার ফলে গ্রামের মানুষ দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, দেশের দারিদ্র্য নিরসনে অগ্রগতি হলেও বৈষম্য বেড়েছে। বৈষম্য বেড়ে গেলে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারও বেড়ে যায়। যেসব দেশের কর কম, সেসব দেশে টাকা চলে যায়। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এখন রাজনৈতিক সমস্যা। ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার পর পর্যন্ত অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে রেমিট্যান্স রফতানি। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে রেমিট্যান্স।

আরেকটি সেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আটটি প্রধান খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তা শ্রেণীর উদ্ভব, নারী ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ বিবর্তন, সামাজিক এনজিও খাতের উন্নয়ন, আইসিটি খাতের অবদান ইত্যাদি। পোশাক শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করেছেন। গত ৪০ বছরে ওষুধ, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। রফতানি ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেন তিনি। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করেছে। সেই সঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন প্রযুক্তির উন্নয়ন ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবেলা করাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তিনি।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে অপশাসন (মেলগভর্ন্যান্স) রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুশাসনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব কারণে রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার পর দেশের উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থার ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি। এসব উন্নয়ন সংস্থাকে সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে অভিহিত করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এসব এনজিও গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা। আর ব্র্যাক বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। এগুলো বাংলাদেশের এনজিও খাতের সাফল্য নির্দেশ করে। এসবের পাশাপাশি আয় বৈষম্য নিয়ে ভাবতে পরামর্শ দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা . মশিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের আজকের উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল। কেননা দেশ স্বাধীনতার পর পরই তিনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ খুঁজেছেন। সেই কর্মকাণ্ডের সুফল এখন পাচ্ছে দেশের মানুষ।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বাড়ছে। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনের সমাপনী সেশনে অর্থনীতিবিদ . কাজী খলিকুজ্জমান আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল লাভ খোঁজে। তারা মূল সমস্যা বা তার সমাধান নিয়ে আগ্রহী নয়। তাই রাষ্ট্রকেই এসব নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বাড়ছে। এজন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন