বাংলাদেশ-ভারত

যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক হতে পারে বন্ধুত্বের প্রধান ক্ষেত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে আগামীতে বন্ধুত্বের প্রধান ক্ষেত্র হতে পারে যৌথ বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হলে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতেই তার প্রভাব পড়বে। আর শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে দরকার দুদেশের সম্পর্ক মজবুত করা। সীমান্ত হত্যার ঘটনা সম্পর্কে চিড় ধরায়। বাংলাদেশ-ভারতের ৫০ বছরের অংশীদারত্ব: আগামী ৫০ বছরের অগ্রযাত্রা শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা।

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ওই সেমিনার যৌথভাবে আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ (আরআইএস) সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। সেমিনারে সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানসহ বেশ কয়েকজন আলোচক ভার্চুয়ালি অংশ নেন। এতে বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান, অধ্যাপক ইমেরিটাস . আইনুন নিশাত, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক . সেলিম রায়হান, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী প্রমুখ। সেমিনার সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক . ফাহমিদা খাতুন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা ন্যায্যতা ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধান করা দরকার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, শান্তি, উপমহাদেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেবল দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের জন্য নয়। গত ৫০ বছর সাক্ষ্য, যথেষ্ট প্রমাণসহ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেবল দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব শান্তির জন্যই নয়, বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উপমহাদেশের উন্নয়নের জন্যও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সালের খসড়া চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য অংশ দেয়া প্রয়োজন, যা এরই মধ্যে উভয় সরকার সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের আন্তরিক প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে এবং চুক্তি দ্রুত শেষ করার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

তিনি বলেন, গোমতী, খোয়াই, কুশিয়ারা, তিস্তা, ফেনী মুহুরীর মতো অভিন্ন নদীতে একটি ন্যায়সংগত সমন্বিত জলবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করা প্রয়োজন, কারণ মানুষ বোঝে যে ভারত বাংলাদেশী জনগণের চাহিদার সঙ্গে ন্যায্যতা মানে। গত ৫০ বছর তাদের আঞ্চলিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বিকশিত দৃশ্যপটে আগামী ৫০ বছরের পথচলার পথ দেখাবে, যেখানে বন্ধুত্ব অংশীদারত্ব আরো গভীর সুসংহত হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্গঠন সক্ষমতা গড়ে তোলার বিষয়ে স্বাধীনতার পর পরই ভারতীয় অঙ্গীকার ৫০ বছর পরও বাস্তবায়িত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের পর যখন পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়, সে সময় ভারত বাংলাদেশের পুনর্গঠন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং তা আলোচনার মধ্যেই রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনায়, বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ভারতকে কাঠামোগত রূপান্তর এবং জলায়নে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় কিন্তু তা অপরিবর্তিত থাকে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আলোচনার সময় ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে পুনর্গঠন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু পানি ভাগাভাগি পুনর্গঠন এবং সংযোগের প্রতিশ্রুতি গত ৫০ বছর ধরে এখনো আলোচনার অধীনে রয়েছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান বলেন, আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র দখল করবে। কারণে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে বাংলাদেশ ভারতকে মনোযোগী হতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের সীমান্তকে ভীতিকর নয়, বরং বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে।

অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুদেশের যৌথ নদী কমিশনের কোনো সক্রিয় কার্যক্রম নেই। ফলে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে টানাপড়েন দূর করার বিষয়ে আলোচনাও তেমন একটা এগোচ্ছে না। কিন্তু অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যত দ্রুত ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হবে, ততই দুদেশের সম্পর্ক সামনের দিকে গতিশীল হবে।

অনুষ্ঠানে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক . সেলিম রায়হান বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে কিন্তু প্রত্যাশিত পর্যায়ে নয়। অনেক অশুল্ক বাধা রয়েছে, যেগুলোর শুল্কমুক্ত বাজার অ্যাকসেসের সুবিধাগুলো কাটার জন্য দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার দখল করতে এখানে বিনিয়োগ করে শুল্কমুক্ত বাজার অ্যাকসেসের সুবিধা নিতে পারে কারণ বাংলাদেশ একটি বিশাল সুযোগ দেয়।

অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, সীমান্ত হত্যা দুঃখজনক, এটা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। সীমান্তে ভারতের দিকেই এটা হয়ে থাকে। কেননা অপরাধীরা সীমান্ত বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। সীমান্ত এলাকায় বর্ডার হাট, অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ালে সীমান্তের সমস্যা কমানো যেতে পারে।

ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, সীমান্তে মানব পাচারও হয়। যৌথভাবে মানব পাচার রোধ করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর আরো সুযোগ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রধান সমস্যা হলো লজিস্টিক। বাণিজ্যের বেশির ভাগই হয়ে থাকে বেনাপোল পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে। তবে শুধু সড়ক পথেই নয়, নদী রেলপথেও বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

আলোচকদের মধ্যে আরো ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো . দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, আরআইএসের মহাপরিচালক . শচীন চতুর্বেদী, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি, ভারতের আরআইএসের অধ্যাপক . প্রবীর দে, অধ্যাপক একসে মোহন্তী, ভারতের ওয়াটার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট . অরবিন্দ কুমার এবং বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সেন্টার হেড . শ্রী রাধা দত্ত এবং নন ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি সেন্টারের হেড . উত্তম কুমার সিনহা। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রুমিন ফারহানা, বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল, আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন