পর্যালোচনা

পাঁচ দশকে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

ড. এম এ মজিদ

ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পশ্চিম বাংলায় দেশীয় ওষুধ শিল্পের গোড়াপত্তন। এটির শুরু হয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের উদ্যোগে। তিনি ১৮৯২ সালে ৭০০ রুপি মূলধন নিয়ে স্থাপন করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস নামের কোম্পানিটি, যা ১৯০১ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড নামে যাত্রা করে। বলা যায়, এটিই উপমহাদেশের তথা বাংলার প্রথম ওষুধ কোম্পানি। পূর্ববাংলার কথা যদি ধরা হয়, তাহলে বাংলায় ওষুধ শিল্প স্থাপনের যাত্রা ১৯৪৭- ব্রিটিশের বিদায় ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর। ১৯৪৮ সালে পাবনায় স্থাপিত এডরুক ফার্মাসিউটিক্যালস পূর্ববঙ্গের প্রথম ওষুধ কোম্পানি। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালে বাগেরহাটে এপিসি ফার্মাসিউটিক্যালস, ১৯৫৬ সালে অপসোনিন কেমিক্যাল, ১৯৫৪ সালে একমি, ১৯৫৮ সালে পাবনায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ১৯৬৮ সালে বরিশালে কেমিস্ট রেফকো ফার্মা এবং ১৯৭০ সালে এশিয়াটিক ফার্মা করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, ১৯৭৬ সালে বেক্সিমকো ফার্মার জন্ম। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫৮টি দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় আটটি বিদেশী কোম্পানিও বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প স্থাপন করে।

বঞ্চনার শিল্প এখন গর্বের ধন: ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডে (পূর্ববঙ্গে) কোনো ওষুধ কোম্পানিই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর যেসব বিদেশী ওষুধ কোম্পানি কারখানা স্থাপন করে, তার অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। শিল্প স্থাপনে চূড়ান্ত বঞ্চনার শিকার হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশে বড়-ছোট মাঝারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ তৈরির সক্ষমতা ছিল। বাকি ৮০ শতাংশ ওষুধের জোগান ছিল না। বলা যায়, সদ্য স্বাধীন মুমূর্ষু এক বাংলাদেশ, যার ওষুধ নেই, পথ্যও নেই। থাকবে কীভাবে, কেনার সামর্থ্যও নেই। ডলারের রিজার্ভ নেই। তাই আমেরিকা-ইউরোপের কোম্পানিগুলো ওষুধ দিতে নারাজ। আর পাকিস্তান তারা তো তখন জাতশত্রু। তারাও বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার জন্য ওষুধ দেবে না। যেন এক বঞ্চনার গল্প। স্বাধীন বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই। এক দুঃসময়। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি। তারা পাট অন্যান্য কাঁচা পণ্যের বিনিময়ে ওষুধ সরবরাহে রাজি হয়। যেন ছিল সামন্ত আমলের ন্যায় এক বিনিময় চুক্তি। যেন ছিল করুণায় বেঁচে থাকা।

বঞ্চনার অন্য দিকটি ছিল আরো ভয়াবহ। সদ্য স্বাধীন রুগ্ণ বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল দুর্বল। যে কয়টি বিদেশী ওষুধ কোম্পানি ছিল তারা ছিল অতি মুনাফালোভী। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব ওষুধের দাম নানা অজুহাতে বাড়িয়ে মুনাফা লাভ ছিল তাদের নেশা। যে জাতি যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, সে কি অন্যের করুণায় বেঁচে থাকবে? বিদেশনির্ভর বিদেশীনির্ভর হয়ে থাকবে? গত পাঁচ দশকে দেশে স্থানীয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ বলে দেয়না, আমরা অন্যের করুণায় বাঁচি না! বাঁচতে চাই না! ওষুধের অভাবগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। এখন বিশ্বকে ওষুধ দেয়। এটি কি গর্বের নয়!

১৯৮২পরিবর্তনের শুরুটা যেখানে: ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৯৪০ সালের প্রণীত আইন ড্রাগস অ্যাক্ট ছিল উপমহাদেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের মূল আইন। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান আইনই ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশও ১৯৭৪ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন গ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে আইনের পরিবর্তে দ্য ড্রাগ রুলস ১৯৪৫ এবং পরে দ্য বেঙ্গল ড্রাগ রুলস জারি হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আইন দ্বারা ওষুধ শিল্প নিয়ন্ত্রণ হতো। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে নতুন ওষুধ নীতি নতুন আইন জারি করা হয়। আইন দ্য ড্রাগস কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ নামে অভিহিত। ১৯৮২ সালের আইনটি পরবর্তী সময়ে ১৯৮২ (একই বছর), ১৯৮৪ ২০০৬ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১৯৪০ সালের অ্যাক্ট ১৯৮২ সালের ড্রাগস কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স দুই আইনের সমন্বয়ে ওষুধের উৎপাদন, বিক্রয় বিপণন, আমদানি-রফতানি, মজুদ, সরবরাহ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৮২ সালে প্রণীত দ্য ড্রাগস কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ড্রাগ পলিসিই বাংলাদেশের স্থানীয় ওষুধ শিল্প বিকাশের মূল প্রভাবক।

১৯৪০ সালের আইনটি ছিল অত্যন্ত দুর্বল ত্রুটিযুক্ত। আইন দিয়ে ওষুধের মতো জীবন রক্ষাকারী পণ্যের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ছিল অসম্ভব। দুর্বলতার সুযোগে বিদেশী ওষুধ কোম্পানি এবং সেই সঙ্গে দেশীয় মাঝারি ছোট সব কোম্পানিই মানহীন অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বানাত। বিদেশী কোম্পানিগুলো প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে দেশে স্থাপিত কারখানায় ইনজেকটেবল অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ না বানিয়ে তাদের মূল কারখানা বা অন্য দেশের কারখানা থেকে আমদানি করত এবং অত্যন্ত চড়া দামে বাংলাদেশে বিক্রি করত। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দেশ থেকে মানহীন অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাতিল করা হয়। ওষুধের দাম নির্ধারণের আইন করা হয়, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ওষুধ প্রেসক্রিপশন করা বন্ধ করা হয়। ওষুধ উৎপাদনে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ করা দরকার, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওষুধ বিশেষজ্ঞ তৈরির লক্ষ্যে ফার্মেসি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা চালু হয়। ১৯৭৬ সালে ফার্মেসি অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে ফার্মেসি পেশাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত দক্ষ জনবলকে স্বাস্থ্যসেবার কোনো সেক্টরে কাজের সুযোগ দেয়া হয়নি। ফলে গ্র্যাজুয়েশন শেষে সবাই আমেরিকামুখী হন। ছিল দেশের জন্য আরেক অপূরণীয় ক্ষতি। ১৯৮২ সালের নতুন ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনে ওষুধ শিল্পে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বাধ্যবাধকতা জারি করলে দেশে ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। দক্ষ পেশাজীবীদের অবদান দেশে তৈরি ওষুধের উৎপাদন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, ওষুধের বাজার সম্প্রসারণ বিকাশে অনস্বীকার্য। অন্যদিকে নতুন আইনে বাধ্যবাধকতা পলিসির কারণে বিদেশী কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ভাটা পড়ে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে মার্কেটে বিস্তার লাভ করে। বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা বিক্রি করে চলে যেতে থাকে। সর্বশেষ গ্লাসগো বাংলাদেশ সানোফি-এভেনটিস তালিকায় যুক্ত হয়।

তৈরি ওষুধ শিল্প বিকাশের খতিয়ান: ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির অনুসরণে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হলে সব ধরনের ওষুধের স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। অতিজরুরি ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং মানহীন ওষুধ তৈরির প্রবণতাও কমে যায়। ১৯৮১ সালে তৈরি ওষুধের স্থানীয় বাজার ছিল ১৭৩ কোটি টাকা। ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১০ কোটি টাকা, ২০১২ সালে হাজার ৩৯০ কোটি, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ৭৫৫ কোটি, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২৬ কোটি, ২০১৯ সালে ২৩ হাজার ১৮৪ কোটি এবং ২০২০ সালে ২৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।

১৯৮১ সালে আটটি বিদেশী কোম্পানিসহ ১৬৬ কোম্পানি দেশে ওষুধ বানাত। এর মধ্যে আটটি বিদেশী কোম্পানি বানাত ৭০ শতাংশ। ১৫৮টি দেশী কোম্পানির মধ্যে মধ্যম সারির ২৫টি কোম্পানি বানাত ১৫ শতাংশ এবং বাকি ১৫ শতাংশ তৈরি করত ১৩৩টি ছোট কোম্পানি। ওই সময় সব কোম্পানি সিরাপ, ভিটামিন, মিকশ্চার, টনিকসহ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বানাত। ১৯৮১ সালে ১৫০ কোটি টাকায় তৈরি ওষুধের জন্য ৬০ কোটি টাকা কাঁচামালে ব্যয় করে। এতগুলো ওষুধ কোম্পানি থাকার পরও প্রায় ২৫ কোটি টাকার তৈরি ওষুধ রফতানি করে।

এবার দেখা যাক মানহীন ওষুধের খতিয়ান। ১৯৭০ সালে বাজারে প্রায় ৩৬ শতাংশ মানহীন ওষুধ ছিল। নতুন পলিসি আইন বাস্তবায়নের ফলে ২০০২ সালে কমে দাঁড়ায় মাত্র শতাংশে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্থানীয় ওষুধ কারখানাগুলো এত রুগ্ণ ছিল, তারা চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ তৈরি করত। বাকি ৮০ ভাগ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ওষুধ শিল্পের চিত্রটি ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় একই রকম ছিল। দেশের সেই রুগ্ণ শিল্প খাত এখন সুস্থ-সবল বলবান যুবকের মতো, তৈরি ওষুধের বিশ্ববাজার যে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক সময়ের ওষুধ আমদানিকারক দেশ এখন বিশ্বের ১৬০টি দেশে তৈরি ওষুধ রফতানি করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ১০৩ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ১৩৬ মিলিয়ন ডলার। দেশের প্রায় ৫০টি কোম্পানি আনুমানিক ৩৫০ ধরনের ওষুধ আমেরিকা, ইউরোপসহ প্রায় সব দেশেই রফতানি করছে। ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে কিনা তৈরি ওষুধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে। স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ তৈরিসহ স্থানীয় বাজারের ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে। উচ্চ প্রযুক্তির মাত্র শতাংশ ওষুধ আমদানি হচ্ছে। ওষুধ শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি আনুমানিক ১২ শতাংশ। খাতে প্রত্যক্ষভাবে দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। পরোক্ষভাবে আরো প্রায় তিন লাখ লোক শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

মেধাস্বত্ব আইন শিথিলের সুবিধা গ্রহণ: বাংলাদেশ ২০০৮ থেকে মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা ভোগ করছে, যা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। বাংলাদেশ সুবিধা গ্রহণ করে অনেক পেটেন্টেড ওষুধ স্থানীয়ভাবে তৈরি করছে এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজরে রফতানিও করছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রপার্টি রাইটস (মেধাস্বত্ব ছাড়) শিথিলের কারণে পেটেন্টেড ওষুধ তৈরিতে কোনো আবিষ্কারক কোম্পানিকে কোনো রয়্যালটি বা ফি দিতে হয় না। বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক কম দামে ওষুধ উৎপাদন করে। এতে দেশের সাধারণ মানুষসহ স্বল্প ব্যয়ে দেশের মানুষ কম দামে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় করতে পারছে। আশা করা যায়, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। মেধাস্বত্ব আইনে ছাড়ের সুবিধা যদি ২০৩৩ সালের পর বাতিল হয়, তখন শিল্পে কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের বিস্তর আলোচনা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আগেই দেনদরবার করতে হবে।

ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে পিছিয়ে কেন?: বর্তমানে ২৭১টি কোম্পানি বাংলাদেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করছে। এর মধ্যে বেশকিছু কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এসব ওষুধ কোম্পানি হাজার ৫০০ ধরনের জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে, যা প্রায় ৩১ হাজার ব্র্যান্ড নামে দেশে তৈরি বিপণন হচ্ছে। ওষুধ তৈরিতে স্থানীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় হাজার ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল ব্যবহার করে। কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি হয়, যা মূলত ভারত চীন থেকে আসে। ওষুধের কাঁচামালের পাশাপাশি প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল সিংহভাগ আমদানি হয়। স্থানীয়ভাবে যে কাঁচামাল প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল তৈরি হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ফাইন কেমিক্যাল, ইন্টারমিডিয়েট এবং অন্যান্য উপাদানও আমদানি করতে হয়। এক কথায় ওষুধের কাঁচামাল তৈরিতে দেশ এখনো অনেক পেছনে।

কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্থানীয়ভাবে ব্যবহূত কাঁচামালের বাজার ছোট। যদিও বাংলাদেশ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব আইনে ছাড় পেয়েছে। কিন্তু ছাড়ের সুযোগ এখনো কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে পেটেন্টেড ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে যেতে পারেনি। এটি করতে পারলে ওষুধের বাজার আরো সম্প্রসারণ হতো। দ্বিতীয়ত, ওষুধের কাঁচামালের কারখানার বিনিয়োগ অনেক বড়। স্থানীয় কোনো কোম্পানির একার পক্ষে এত বড় বিনিয়োগ করে রিটার্ন পাওয়া দুঃসাধ্য।

তৃতীয়ত, ভারত চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে সংশয়। কাঁচামাল (এপিআই) শিল্পের ঘাটতি রয়েছে, আছে জনবল গবেষণার ঘাটতি। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় যে এপিআই পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ৪২টি কোম্পানিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অল্প জায়গায় এতগুলো কোম্পানির প্লট বরাদ্দ দেয়ায় ভবিষ্যতে তারা আর কারখানা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। ভালো হতো যদি আলোচনা করে কয়েকটি কোম্পানি একেকটি ওষুধের কাঁচামাল তৈরির কারখানা স্থাপন করত। এতে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে রফতানিও করা যেত। এত ছোট জায়গায় সবাই যদি সব ধরনের কাঁচামাল তৈরি করে তাহলে কিনবে কে? সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ এপিআই পার্কের প্লটে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি গবেষণার জন্য একটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন ছিল, সেটি হয়নি।  

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলো কাঁচামাল তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারলে ওষুধের রফতানি আয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ধারণা করা হয়, স্থানীয় বাজার কয়েক মিলিয়ন ডলার হবে। কিন্তু সম্ভাবনাময় বাজার ধরার জন্য বিস্তর চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে।

. বাংলাদেশে যে কাঁচামাল ব্যবহূত হয় তার প্রায় ২০ শতাংশ পেটেন্টেড। যদি বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পায় এবং ২০৩৩ সালের পর মেধাস্বত্ব আইনের ছাড় বাতিল হয়ে যায়, তখন পেটেন্টেড ওইসব কাঁচামাল আবিষ্কারক কোম্পানির কাছ থেকে অতিমূল্যে কিনতে হবে। ফলে ওষুধের দাম স্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাবে। . এপিআই পার্কে বরাদ্দপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর কারখানা স্থাপন উৎপাদন বেশি হলে কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনও বেশি হবে। ফলে ২০৩৩ সাল ছাড়ের সুবিধা কোম্পানিগুলো নিতে পারবে না। . বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো জিএসপি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ছাড়ের সুবিধায় বর্তমানে তৈরি ওষুধ রেগুলেটেড, সেমিরেগুলেটেড নন-রেগুলেটেড সব দেশেই ওষুধ রফতানি করছে। অনেক দেশেই এখন ওষুধের বায়োইকুইভ্যালেন্স স্টাডি রিপোর্ট চায় না। ফলে বায়োইকুইভ্যালেন্স ডাটা ছাড়াই বাংলাদেশ অনেক দেশে ওষুধ রফতানি করছে। ২০২৬ সালের পর কিংবা ২০৩৩ সালের পর বাংলাদেশ সুবিধা যদি হারায় তখন ওষুধ রফতানিতে ঘাটতি বাড়বে। দেশে বর্তমানে ১৩টির মতো কন্টাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্থানীয় বা রফতানি বাজার বায়োইকুইভ্যালেন্স স্টাডি ডাটা না লাগায় সিআরওগুলোর হাতে তেমন কাজ নেই। যদি সিআরওগুলো কাজ না পায় বা সচল না থাকে, তবে ভবিষ্যতের জন্য এটি বড় বাধা হবে। . ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অ্যাক্রেডিটেশন পায়নি, এমনকি বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্সপেকশন কো-অপারেশনের সদস্যপদ পায়নি। যদি স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়, তবে ২০২৬ সালের পর কিংবা ২০৩৩ সালের পর ওষুধের রেগুলেটেড সেমিরেগুলেটেড দেশগুলোয় রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ্য, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অ্যাক্রেডিটেশন পেতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি ফিজিক্যাল কেমিক্যাল ল্যাব অ্যাক্রেডিটেশন পেয়েছে। . বর্তমানে ছোট মলিকিউল আবিষ্কারের তুলনায় বড় মলিকিউলের (বায়োটেক ড্রাগ) গবেষণা আবিষ্কার বেশি গতিশীল। ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসায় বায়োটেক ওষুধ প্রাধান্য পাবে এটি নিশ্চিত। বাংলাদেশ বর্তমানে চীন, ভারত অন্যান্য দেশ থেকে বায়োসিমিলার ওষুধ রেডি ফর্মে কিনে এনে বোতলজাত প্যাকেজিং করছে। ফলে বায়োসিমিলার ওষুধের গবেষণায় বিরাট ঘাটতি রয়েছে। যদিও দেশে বিষয়ে দক্ষ লোকবল আছে। . জাতীয় পর্যায়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো নেই, যা ভারত অন্যান্য দেশে কয়েক দশক আগেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জেনেরিক ড্রাগগুলোর কাঁচামাল তৈরির প্রযুক্তি পদ্ধতি সহজেই ডেভেলপ করতে পারত এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারত।

উপরোক্ত চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি গ্যাস-পানি বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, পানি বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে প্রায় হাজার কোটি টাকার ওষুধের চোরাচালান হয়, তা বন্ধ করতে হবে। আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ওষুধ খাতের জন্য দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে একাডেমিক-ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন জরুরি। সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে জোর লবিং করতে হবে, যাতে ২০৩৩ সালের পরও মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা অন্তত আর ১০ বছর বহাল থাকে।

 

. এম মজিদ: অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ

ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন