সময়ের ভাবনা

৫জি প্রযুক্তির ব্যবহার ত্বরান্বিত করা প্রসঙ্গে

টিম শাও

১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ (ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ) ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তথ্য প্রেরণের যুগান্তকারী উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিক উন্মোচন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে খাতে আরো ব্যাপক উন্নতি ঘটতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মানুষের জীবনকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় সহজতর করে তুলতে প্রযুক্তিগত বিকাশের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ খাতে অন্তর্ভুক্তি ঘটে প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্কের। 

১৯৭৯ সালে শুধু কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগের সুবিধা নিয়ে প্রথম প্রজন্মের নেটওয়ার্কের আবির্ভাব ঘটে। এরপর ধারাবাহিকভাবে কথা বলতে পারার পাশাপাশি খুদে বার্তা (এসএমএস) মাল্টিমিডিয়া বার্তা (এমএমএস) আদান-প্রদান করার সুবিধাসহ ১৯৯১ সালে আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক (টুজি), ২০০১ সালে ভিডিও কল, মেইল আদান-প্রদান, ওয়েব ব্রাউজিং, লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মতো সেবা নিয়ে আসে তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক (থ্রিজি) এবং ২০০৯ সালে উন্নত গেমিং, এইচডি মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্সিং, আইপি টেলিফোনসহ উচ্চগতিসম্পন্ন সেবা নিয়ে আসে চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক (ফোরজি) সর্বশেষ বর্তমান সময়ে এসে বিশ্ব এখন আরো উন্নত উদ্ভাবনী প্রযুক্তির পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট (ফাইভজি) যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে সময়ের সঙ্গে নতুন প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্কের উদ্ভাবনের পর যেসব দেশ যত দ্রুত এসব নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছে, সেসব দেশ প্রযুক্তি খাতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সামাজিক খাতে তত দ্রুত উন্নতি করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের চেয়ারম্যান ক্লাউস সোয়াব ২০১৬ সালে প্রকাশিত তার দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন বইয়ে ডিজিটাল বিপ্লবকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে উল্লেখ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল চালিকাশক্তি হবে প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্ক। তাই যেকোনো দেশের জন্যই আগামীর প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে দ্রুত প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্কের সর্বশেষ সংযোজন ফাইভজি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা জরুরি। 

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও গত দশকের শেষের দিক থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য অর্জনকে আরো ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশকে দ্রুত ফাইভজি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে হবে। এর আগে ২০০১ সালে প্রথম চালু হওয়া থ্রিজি নেটওয়ার্ক দেশে চালু করতে বাংলাদেশ সময় নিয়েছিল প্রায় ১২ বছর এবং ফোরজি চালু করতেও সময় নিয়েছে অনেক। সার্বিকভাবে ডিজিটাল উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও আরো দ্রুত সময়ে দেশে প্রজন্মভিত্তিক নেটওয়ার্ক চালু করতে পারলে দেশের প্রযুক্তিগত অর্থনৈতিক খাতে আরো উন্নয়ন ঘটত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সব স্তরের মানুষের অন্তর্ভুক্তি না থাকলে ফাইভজি সেবার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা গ্রহণ সম্ভব হবে না।

দেশে বিস্তৃত পরিসরে ফাইভজি সেবা চালু করতে প্রথমেই সবার জন্য ফাইভজি সমর্থন করে এমন ডিভাইস নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাধারণত দেখা যায়, উন্নত প্রযুক্তির ফোন বাজারে এলে তার মূল্য অত্যধিক হয়। ফলে শুধু উচ্চবিত্তরাই উন্নত প্রযুক্তির সেবা গ্রহণ করতে পারেন এবং বাকিরা সেবার নাগাল পান না। সবার কাছে সমানভাবে উন্নত প্রযুক্তি না পৌঁছলে এর সামগ্রিক সুফল উপভোগ সম্ভব নয়। তাই স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা চিন্তা করে সাশ্রয়ী মূল্যের ফাইভজি ফোন বাজারে আনার কথা ভাবতে হবে। তবে আশার কথা, এরই মধ্যে অনেক স্মার্টফোন নির্মাতা ব্র্যান্ড এমন ফোন বাজারে আনা শুরু করেছে।

ফাইভজির ডাটা ট্রান্সমিশন রেটের পূর্ববর্তী ফোরজির থেকে প্রায় ১০০ গুণ বেশি হবে বলে জানিয়েছেন প্রযুক্তিবিদরা, যার স্পিড সেকেন্ডে ৫০ এমবি থেকে জিবি পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া কোয়ালকমের তথ্যমতে, আইএমটি-২০২০ স্ট্যান্ডার্ডে এর গতি প্রায় সর্বোচ্চ ২০ জিবি পর্যন্ত হবে। তবে সেবা পেতে হলে দেশে সুলভ মূল্যে স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বাড়িয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। ফাইভজির মাধ্যমে উচ্চ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নিরবচ্ছিন্ন দ্রুত নেটওয়ার্ক সংযোগ ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে উন্নত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিদ্যমান ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেশীয় সরকারি মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ফাইভজি সেবা চালু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করেছে। বিষয়টিকে ফাইভজি প্রযুক্তি গ্রহণে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

দেশে পর্যায়ক্রমে টুজি, থ্রিজি ফোরজি সেবা আসার পরও এসব সেবায় গ্রাহকরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এখনো দেশের সর্বত্র ফোরজি সেবা নিশ্চিত হয়নি। এমনকি অনেক এলাকায় থ্রিজি নেটওয়ার্কও এখনো পৌঁছেনি, যা হতাশাজনক। গ্লোবাল মোবাইল কমিউনিকেশনের (জিএসএমএ) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে ফোরজি সেবা চালুর এক বছর পরও তা মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ গ্রহণ করেছে এবং একই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হার আগামী ২০২৫- এসে মাত্র ৪৬ শতাংশে পৌঁছবে। এছাড়া ইন্টারনেটের গতির দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। ডিজিটালাইজেশনের অগ্রযাত্রায় দ্রুত অগ্রসরমাণ হলেও এসব ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক কঠিন হবে। এক্ষেত্রে দেশের টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ ফাইভজি সেবা গ্রহণে আরো উৎসাহী হবে।

পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের ৫জি প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। মোবাইলে বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তি যে ফোনের সঙ্গে বিভিন্ন ডিভাইসকে সংযুক্ত করে মানুষের জীবন আরো সহজ করে তুলবে এবং অবকাঠামো, চিকিৎসা, যানবাহন, ক্লাউড গেমিং, আইওটিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক সুবিধা দেবে, সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা থাকা প্রয়োজন। অন্যান্য প্রজন্মের নেটওয়ার্কের সঙ্গে ফাইভজির গুণগত ব্যবহারিক পার্থক্য এবং এর যথাযথ প্রয়োগ সম্পর্কে জানা না থাকলে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে না।

সরকার, ফোন নির্মাতা ব্র্যান্ড, টেলিকম প্রতিষ্ঠানসহ শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে দেশে ফাইভজি প্রযুক্তি সেবা চালুর ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এবং দেশে ডিজিটালাইজেশনের অগ্রযাত্রা আরো বেগবান করতে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সর্বস্তরের মানুষের কাছে ফাইভজি প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

 

টিম শাও: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রিয়েলমি বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন