বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত

স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতদ্বৈধতা দ্রুত নিরসন জরুরি

বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে আলোচনা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে মুদ্রাবাজারের সঙ্গে পুঁজিবাজারের সামঞ্জস্য নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুর নিষ্পত্তি সহজ হয় এবং অর্থনীতির গতিপথ হয় মসৃণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য বেড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বৈঠকটি ছিল খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। বৈঠকে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় যোগাযোগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। ইতিবাচক সংবাদ। নিয়মিত বিরতিতে ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে বিরোধ তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে আসবে। এটি মুদ্রাবাজার পুঁজিবাজার উভয়ের জন্যই জরুরি। তবে বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া হতাশার। প্রত্যাশা থাকবে, দ্রুতই আলোচনার মাধ্যমে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতদ্বৈধতা নিরসন হবে।

পুঁজিবাজার সংবেদনশীল জায়গা। এখানে যেকোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে। পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য এককভাবে কেউ কিছু করতে পারবে না। প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর বিএসইসির যৌথ সহযোগিতা। পুঁজিবাজার সম্পৃক্ত কোনো কিছু জারি করতে গেলে বিএসইসির সঙ্গে আলাপ করে নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। ঠিক একইভাবে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিএসইসিরও উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহযোগী ভূমিকাই পারে শক্তিশালী আর্থিক খাত গঠন করতে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, কোনো রেগুলেটরি সিদ্ধান্ত যেন কারো অসুবিধার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। মতবিরোধ এড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ আরো বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইন বিধিমালার মধ্যে যেসব বিষয়ে জটিলতা বা দ্বৈধতা রয়েছে, তা নিরসনেরও উদ্যোগ নেয়া দরকার। বিনিয়োগকারী আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। আইনের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ যেমন নেয়া ঠিক হবে না, তেমনি মুদ্রাবাজার পুঁজিবাজারের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে এমন উদ্যোগকে সহায়তা জোগাতে হবে। সর্বাগ্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত নিরসন প্রয়োজন, যা মুদ্রাবাজার পুঁজিবাজার উভয়ের স্থিতিশীলতার জন্য প্রত্যাশিত। পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল গঠন, এক্সপোজার লিমিট, মার্জিন ঋণ, বন্ড ইস্যু প্রভৃতি বিষয় ঘিরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিএসইসি যে মতদ্বৈধতা তৈরি হয়েছে, দ্রুতই তা নিরসন করা প্রয়োজন। নতুবা মুদ্রাবাজার পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের যে আস্থা তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখা চাই।

শুধু বাংলাদেশ নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তগত দ্বন্দ্ব ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও দেখা যায়। এসব বিরোধ নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। অবস্থান, পরিস্থিতি অনুযায়ী যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রচেষ্টা থাকে। কয়েক বছর আগে ২০১৮ সালেই সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মধ্যে কোম্পানির তথ্য প্রকাশ, পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণসহ কিছু বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনে বিষয়গুলোয় তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। এতে উভয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরোধের অবসান ঘটে। এমনকি উভয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়মিতই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠকে বসে। তাদের মতদ্বৈধতার বিষয়গুলো সেখানেই আলোচনা হয়, জনসম্মুখে হয় না। ফলে পুঁজিবাজার মুদ্রাবাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুটির বিরোধের বিষয়টি জনসম্মুখে বেশি উন্মোচন হয়ে পড়ছে, যা কারো জন্যই কাম্য নয়।

মতদ্বৈধতা নিরসনে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় যোগাযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মঙ্গলবারের অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানানো হয়। নিয়মিত আলোচনা পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। একথা সত্য, দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থাই অর্থনীতির ইতিবাচক অগ্রগতির কথা চিন্তা করছেন। এক্ষেত্রে প্রক্রিয়া বা পথটি ভিন্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আইনের মধ্যে থেকে যেটি অপেক্ষাকৃত ভালো সিদ্ধান্ত, সেটিই গ্রহণ করা শ্রেয়। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের অবস্থানসহ অন্যান্য দেশের কার্যক্রম আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিএসইসির মধ্যে সমন্বয়হীনতা আরো একবার সামনে এলো বৈঠক শেষে উভয়ের বক্তব্যে। এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যাখ্যা বক্তব্য অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে মিলছে না। ধরনের ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় প্রভাব ফেলবে বৈকি। এতে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে, যা প্রত্যাশিত নয়।

মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। দুটি সংস্থার সমন্বয় ছাড়া দুই বাজারের স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হলে বা টাকার প্রবাহ কমাতে উদ্যোগ নিলে যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে, তেমনিভাবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে বিএসইসি ব্যর্থ হলে ব্যাংকসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ে। আর এজন্যই নিয়ম না থাকলেও দুই সংস্থার নীতিনির্ধারণীমূলক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংশ্লিষ্টরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসির বিদ্যমান নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কিনা, তা বিবেচনা করেন। তবে সামান্য ভুলের কারণে যেমন বড় ধরনের ক্ষতি হয়, সামান্য অবহেলার কারণে মূল্যবান সম্পদ যেমন খোয়া যায়, তেমনি তদারকি ব্যবস্থা জোরদার না করলে বা সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে দুই বাজারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের মাধ্যমে। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। এক্ষেত্রে উভয়ের সমন্বয় যথাযথ সিদ্ধান্ত জরুরি।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থাই নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। কোনো বিষয়ে জটিলতা দেখা দিলে উভয় সংস্থা সাধারণত সমন্বয়ের মাধ্যমে তা সুরাহা করে। তবে কখনো কখনো দুই সংস্থা কোনো কোনো ইস্যুতে পরস্পরের বিরোধিতা করে। তাদের সম্পর্কেও অবনতি ঘটে। তবে আলোচনার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে আমানতকারী বা বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। পুঁজিবাজার, আর্থিক বাজারসহ বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকর সমন্বয় আন্তরিক সহযোগিতার অভাবে পুঁজিবাজারের প্রকৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। কোনো কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত মাঝেমধ্যে পুঁজিবাজার অস্থির করে তুলছে, যা কাম্য নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন