কামরুল হাসান একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব। শুধু শিল্পচর্চার জন্য নয়। আমাদের সামাজিক পরিবর্তনের যে আন্দোলনগুলো সেগুলোয় তার অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা চাইছি তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে। যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে নিয়ে কোনো আয়োজন হয়ে ওঠে না। যদিও তার বিশাল কর্মজীবন তরুণ প্রজন্মের দেখার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী আমাদের মতো করে তার কাজের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে জন্মশতবার্ষিকীটা উদযাপনের চেষ্টা করেছি। সে হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে দুজন শিল্প সংগ্রাহকের সন্ধান পাই। তারা দিতে রাজি হন। এ দুজন শিল্প সংগ্রাহকের কাছ থেকে বিভিন্ন মিডিয়ায় আঁকা ১১০টা ছবি সংগ্রহ করি এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমে কামরুল হাসানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। একজনের কাছে পেয়েছি ১০০টি, আরেকজনের কাছে পেয়েছি ১০টি। আমরা এ প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি সহজিয়া।
কলাকেন্দ্রের আয়োজক হিসেবে বলতে পারি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করার পেছনে কামরুল হাসানকে যেভাবে আমরা চিহ্নিত করি, তার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। পয়েন্টগুলো বলে দেবে এ সময়ে কামরুল হাসান কতটা প্রাসঙ্গিক। তিনি তিনটা সময়কে দেখেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এ তিনটা সময়ের প্রতিটি প্রগ্রেসিভ মুভমেন্টে তার অংশগ্রহণ ছিল। তিনি অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। বলা যায়, তিনিই আমাদের দেশের একমাত্র শিল্পী, যার ছবির সংখ্যা কত তা নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব। কেননা ছোটবড় বিভিন্ন সাইজের অসংখ্য ছবি তিনি এঁকেছেন। তার মানে একটা লোক প্রতিনিয়ত ক্রিয়েটিভ প্রসেসের মধ্যে থাকতেন। এটা একটা বিশেষত্ব। ছবি আঁঁকা ছাড়াও আমাদের জীবনের প্রতিটা অংশে যে এক ধরনের নান্দনিকতা দরকার, সেটার বিষয়ে তিনি ছিলেন সচেতন। ফলে তিনি শুধু ছবি আঁকেননি। প্রচ্ছদ এঁকেছেন, বুক ডিজাইন করেছেন, শাড়ির ডিজাইন করেছেন, লোগো ডিজাইন করেছেন। একজন শিল্পীর যতগুলো জায়গায় নান্দনিক উপস্থাপনা দরকার তিনি সব জায়গায় হাত দিয়েছেন। এতে তার কোনো জড়তা ছিল না। তিনি যা-ই করেছেন সবই ছিল বাংলাকেন্দ্রিক। তার ছবির যেকোনো মানুষকে দেখলেই বোঝা যায় এটা বাঙালি। তার ছবির নর-নারী বাঙালি, লতা-পাতা, গাছ-পালা, আলো-বাতাস, তার মিথলজি, কল্পনা, ইচ্ছা, তার স্বপ্ন যা কিছু এঁকেছেন সবই এ দেশীয়। পুরো ইকোসিস্টেমটা ধরার একটা প্রবণতা ছিল। এটা একটা বিশেষত্ব। কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা ছাড়া বিশ্ব শিল্পের ধারাবাহিকতা, পরম্পরা সেটারই এক ধরনের আধুনিক রূপ তিনি দিয়েছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার যে তিনি আমাদের শিল্পকে এ অঞ্চলের শিল্পে পরিণত করেছেন। আমরা অনেক সময় এটা নিয়ে জড়তা প্রকাশ করি। একজন বাঙালি ও বাঙালি শিল্পী হিসেবে তার মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা ছিল না। এ ব্যাপারগুলো রাজনৈতিক অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে দেখা যায়, এটা ছিল সচেতন সিদ্ধান্ত। আরেকটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ, এ অঞ্চলের আলো, বাতাস, জল, মানুষজনকে তিনি এত সতেজ, এত সুন্দর এবং এত রস নিয়ে এঁকেছেন, যেটা আর কোনো শিল্পী কোনোদিন আঁকেননি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে তার পোস্টার, সংবিধানের ডিজাইন, জাতীয় পতাকার ডিজাইন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের উদ্ভব থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জায়গায় জাতীয়ভাবে অবদান রয়ে গেছে। এ রকম একজন শিল্পী সবসময় এ দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। তার কাজ দিয়ে নিজেকে বুঝতে পারা যায়। নিজেদের শিল্প কী হতে পারে তার কিছু ইঙ্গিত তার মধ্যে পাওয়া যায়। একজন শিল্পীর রাজনীতিসচেতনতা এবং কী ভূমিকা রাখতে পারেন, কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন তার ইঙ্গিত থেকে যায়। তার মানে জীবনযাপন সর্বত্র শিল্প ও প্রগতিশীলতার একটা উদযাপন তার মধ্যে ছিল। এজন্য আমি মনে করি, তার প্রাসঙ্গিকতা সবসময় আছে। প্রজন্মকে তার সম্পর্কে জানতে হবে। তার প্রাসঙ্গিকতা আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তরুণ প্রজন্মের তার কাজগুলো দেখার সৌভাগ্য হয় না। আমাদের জাদুঘর বা জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের কোনো আয়োজন নেই। তার বেশির ভাগ কাজ ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে। তার কাজগুলো মানুষের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা আমরা করেছি। বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছরে কামরুল হাসানের ১০০ বছর হলো। রাজনৈতিকভাবে দেখলেও কামরুল হাসানের জন্মশতবার্ষিকী অনেক বড় উদযাপন হওয়ার কথা।
