নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি

নতুন চ্যালেঞ্জে আবাসন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দেড় বছর স্থবির ছিল দেশের আবাসন খাত। বর্তমানে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা।

বিশ্ববাজারে ক্রমে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের রডের বাজার। অপরাপর নির্মাণ পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রড, ইট, সিমেন্ট, বৈদ্যুতিক কেবলসহ আনুষঙ্গিক নির্মাণ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভবন নির্মাণের ব্যয়ও বেড়েছে। যার কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকা ফ্ল্যাটগুলো ক্রেতাদের কাছে বুঝিয়ে দিতে বেগ পেতে হচ্ছে আবাসন ব্যবসায়ীদের। সম্প্রতি ফ্ল্যাটের বিক্রি বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগও নিয়েছে আবাসন কোম্পানিগুলো। আবাসন মেলা, বিশেষ মূল্য ছাড়সহ নানামুখী ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে কাজ করছে আবাসন কোম্পানিগুলোর সংগঠন রিহ্যাব। তবে কাঁচামালের ক্রমে মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট ক্রয় নির্মাণ খাত কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে বড় ক্রেতাদের ক্রয়সীমা অতিক্রম করায় আগামীতে আবাসন খাতে বড় ধরনের সংকট অপেক্ষা করছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

গত এক মাসের ব্যবধানে দেশে রডের দাম বেড়েছে টনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া গত এক বছরের ব্যবধানে সার্বিকভাবে রডের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। বর্তমানে টনপ্রতি রড বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অধিকাংশ মাঝারি ছোট ইস্পাত পণ্য কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে করোনাকালীন সংকটে বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করা ফ্ল্যাটে বেশি মূলধন ব্যয়ের কারণে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছে কোম্পানিগুলো। 

এদিকে রডসহ বিভিন্ন কাঁচামালের পাশাপাশি নির্মাণ খাতের ব্যবহার্য অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। এছাড়া লিফট, বৈদ্যুতিক কেবলস, টাইলস, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, রঙ-জাতীয় পণ্যের দামও বেড়ে যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছে কোম্পানিগুলো। আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা ফিনিশিং খরচের দ্বিগুণেরও বেশি ব্যয়ে ফ্ল্যাট বিক্রিতে লোকসানের মুখে পড়েছে কোম্পানিগুলো। নির্মাণসামগ্রীর দাম না কমলে দেশের আবাসন খাত নতুন করে হোঁচট খাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। 

রিহ্যাব, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুল কইয়ুম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাকালীন দেশের আবাসন খাত কঠিন সময় পার করেছে। বর্তমানে সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে আবাসন ব্যবসায়ীরা। রডসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪৬ শতাংশ। কারণে পুরনো ফ্ল্যাট ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিতে লোকসানের মুখে পড়েছে কোম্পানিগুলো। তবে লোকসান হলেও পুরনো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার পর নতুন ফ্ল্যাট বিক্রিতে দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।

বাজার সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশে ইটের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক রকম। আগে প্রতি ইউনিট ইট থেকে টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১০ থেকে ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নির্মাণ মৌসুম শুরু হওয়ার পর মূল্যবৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ইটের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সিমেন্টের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা। অন্যদিকে গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের দাম গত ছয় মাসের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে শেষ পর্যায়ে এসে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। এছাড়া গত ছয় মাসের ব্যবধানে দেশের প্রায় সব ধরনের বৈদ্যুতিক কেবলসের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় এসে অনেক প্রতিষ্ঠান ক্রেতাকে দেয়া সময়সীমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছে না।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী ইস্পাত পণ্যের দাম বাড়ার কারণে দেশে লিফট অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের দাম আগেই ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তাছাড়া কনটেইনার সংকট, শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়ার কারণে সময়ক্ষেপণে আমদানি পর্যায়ে আরো খরচ যুক্ত হয়েছে। এসব সংকটের কারণে সময়মতো সরবরাহ করতে পারছে না দেশের লিফট বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে লোকসানের কারণে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনায়ও রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

অরবিট টেকনোলজি লিমিটেডের পরিচালক এমদাদ উর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আবাসন খাতের সর্বশেষ পণ্য লিফট। করোনাকালীন অনেক প্রতিষ্ঠান বিলাসী পণ্য কেনেনি। কভিডের প্রকোপ কমার পর কার্যক্রম শুরু হলে আমরা বেশকিছু কার্যাদেশ পেয়েছি। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থেকে সীমিত লাভে কার্যাদেশ নিলেও স্টিলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে উৎপাদন পর্যায়ে ২০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে লিফটের। তাছাড়া শিপিং ব্যয় বেড়ে যাওয়া, কনটেইনার জাহাজ সংকটে সময়ক্ষেপণের কারণে লিফট ব্যবসায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব আবাসন খাতে পড়ছে বলে মনে করছেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন