পালিত হলো জাতীয় আয়কর দিবস

কর আহরণ বাড়াতে রাজস্ব ব্যবস্থা আরো সহজ করা হোক

প্রায় দুই বছর ধরে চলছে করোনা অতিমারী। এর প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। বাদ নেই কর-রাজস্ব আহরণেও। তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আহরণ হয় মাত্র লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয় লাখ হাজার কোটি টাকা। এটিও অর্জন হয়নি। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অতিমারীর অব্যাহত নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেটি কতটুকু পূরণ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ব্যক্ত করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশে পালিত হলো জাতীয় আয়কর দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কর আহরণে করদাতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বিষয়টি অবশ্যই বেশ সময়োপযোগী। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা খুব একটা করদাতাবান্ধব নয়। কাজেই করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতে রাজস্ব ব্যবস্থা আরো সহজ ঝামেলাহীন করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকার তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কাম্য।

দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাড়াতে হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর আহরণ আশানুরূপ বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় পরিচালনায় আর্থিক চাপে পড়ছে সরকার। কর আহরণ না বাড়ার পেছনে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে। দেশ স্বাধীন হলেও কর ব্যবস্থা এখনো ঔপনিবেশিক আদলে চলছে। এর পদে পদে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা বিরাজমান। একটি আয়কর আইন থাকলেও সেটি পাকিস্তান আমলের আইনের ছায়া অবলম্বনে প্রণীত। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। পুরনো আইন বর্তমান সময়ের অধিক্ষেত্রের অনেক কিছুই কাভার করতে পারছে না। অনেক দিন কর ব্যবস্থায় অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। সেটি চলছে ঢিমেতালে। তদুপরি দেশে করসংক্রান্ত আইনি জটিলতা বিস্তর। চলমান মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে লাগছে দীর্ঘ সময়। আছে কর প্রশাসনের জনবলের ঘাটতি। বিপুল জনসংখ্যা অনুপাতে কর সেবাপ্রদানকারী লোকবল কম। যারা আছে তাদের দক্ষতা ঘাটতিও প্রবল। করজাল বাড়ছে না তেমন। ব্যবস্থার কারণে কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে প্রচুর। আবার কর আরোপণ মোটেই প্রগতিশীল নয়, বৈষম্যমূলক। ধনীরা কর দিচ্ছে মধ্যম আয়শ্রেণীর ব্যক্তিদের সমান। করযোগ্য আয় থাকলেও অনেক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান করের বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া অনেকেই কর দিলেও অনেক ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সেটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না।  সব মিলিয়ে আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে না কর আহরণ।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কর-জিডিপির গড় অনুপাত ৩৬ শতাংশের মতো। উদীয়মান এশীয় দেশগুলোর অনুপাতও গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত সাড়ে ১৮ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা খ্যাত আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপির গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের, প্রায় ১৯ শতাংশ। এরপর ভুটানের, ১৬ শতাংশ। ভারতের ১২ শতাংশ, শ্রীলংকার ১১ দশমিক শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ, আফগানিস্তানের দশমিক শতাংশ এবং মালদ্বীপের দশমিক শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র শতাংশের ঘরে। উল্লিখিত দেশগুলোয় রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মূলে কাজ করছে আধুনিক, সহজ নির্বিঘ্ন কর ব্যবস্থা, দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি একটি সহায়ক রাজস্ব সংস্কৃতি। সুতরাং তাদের নীতি, পদক্ষেপ, রাজস্ব সংস্কৃতি আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

বলা হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অথচ উল্টো প্রবণতা হচ্ছে, করোনার কারণে সেটি বরং আগের চেয়ে কমছে। এটা আশঙ্কাজনক। অবস্থায় কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। এজন্য এনবিআরের অটোমেশনে গতি আনা খুব জরুরি। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, উপরন্তু নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডাটাবেজের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। সংস্থাটি এরই মধ্যে অবশ্য কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব বিভাগে কর গোয়েন্দা সেলকেও আরো সক্ষম কার্যকর করা চাই। বিশ্বায়নের যুগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে।

এর মধ্যেই বহুপ্রতীক্ষিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। কিন্তু এর ফলে নানাভাবে হয়রানির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। হয়রানি কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আয়কর আইন যুগোপযোগী এবং বাংলায় করাটা দীর্ঘদিনের দাবি। এটি এখন বাংলা ভাষায় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে খবর মিলছে। এটা হলে অনেক অস্পষ্টতা দূর হবে এবং জনগণও -সম্পর্কিত বিধিবিধান সহজেই জানতে পারবে, যা কর বাড়াতে সহায়ক। প্রতি বছরই করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রায় উল্টো। যারা নিয়মিতভাবে কর দেন, তাদের ওপরই দেয়া হয় বাড়তি চাপ। কয়েক বছর ধরে নতুন করদাতা নিবন্ধন বাড়ানোর হিসাব দেয়া হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি খুবই কম। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বা করপোরেট কর পাওয়া যায়, এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও তেমন বাড়েনি। ফলে বাড়তি চাপ নিতে হয় মূলত নিয়মিত সৎ করদাতা বিশেষভাবে পেশাজীবী সম্প্রদায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। এটা হতাশাজনক। বড় শহরগুলোয় কর দেয়ার প্রবণতা বেশি হলেও মফস্বল পর্যায়ের অনেক সচ্ছল ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান করের আওতায় নেই। উদীয়মান গ্রোথ সেন্টারগুলো চিহ্নিত করে তাদের করের আওতায় আনতে হবে। এজন্য স্থানীয় কর কার্যালয়গুলো আরো কার্যকর দক্ষ করে তোলা চাই।

কর আহরণ শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ জোগানো নয়, এটি অর্থনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও অন্যতম মাধ্যম। ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে দরিদ্র গোষ্ঠীকে সহযোগিতা করাএটি রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতার বড় স্তম্ভ। নইলে বৈষম্য মোকাবেলা কঠিন। সামাজিক দৃষ্টিকোণের বাইরে উন্নয়নের জন্যও কর আহরণ বাড়াতে হবে। রূপকল্প অনুযায়ী দেশ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তেমনটি হলে আমাদের অবশ্যই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়াতে হবে। কর আহরণে বিরাজমান হার দিয়ে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই করদাতাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো উৎসাহিত করতে হবে, প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে, জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে, ব্যবস্থা আধুনিকায়ন সহজীকরণ করতে হবে, চালিয়ে যেতে হবে আইনি কাঠামোগত সংস্কারগুলো। সর্বোপরি বিনির্মাণ করতে হবে কর পরিপালনের সংস্কৃতি সহায়ক পরিবেশ। রাষ্ট্রীয় অব্যাহত প্রচেষ্টায় এক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটবেএটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন