বিশ্ববাজারে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ৩ হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলারের কিছু বেশি মূল্যের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এর সিংহভাগই গিয়েছে গুটি কয়েক দেশে। পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এ সময়ে রফতানি হওয়া পোশাকের ৮০ শতাংশেরই দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৫ ডলারের আশপাশে।
বাংলাদেশ থেকে রফতানীকৃত পোশাকের মধ্যে টি-শার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটার, শার্ট ও আন্ডার গার্মেন্ট—পাঁচ পণ্যেরই প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। রফতানীকৃত পোশাকের প্রায় ৭৫ শতাংশ জুড়ে ছিল পণ্য পাঁচটি। রফতানিতে মূলত লো-এন্ডের (কম মূল্য সংযোজিত) পণ্যের আধিক্য বেশি থাকায় দামের ক্ষেত্রে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গোটা বিশ্বে কম মূল্যের বা লো-এন্ড রেঞ্জের পোশাকের বাজারই বড়। এ ধরনের পণ্য বেশি পরিমাণে উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো বাংলাদেশ। এসব পণ্যের ক্রয়াদেশের পরিমাণ বেশি। আবার ভোক্তা চাহিদাও বেশি। শুরু থেকেই বাংলাদেশের শ্রম ব্যয় তুলনামূলক কম। ফলে লো ও মিড রেঞ্জের (নিম্ন ও মাঝারি মাত্রায় মূল্য সংযোজিত) পোশাকের ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে, এখনো বেশি আসে। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ওজনভিত্তিক দাম নিয়ে বিজিএমইএর বিশ্লেষণে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৬৮ কোটি ডলারের ট্রাউজার রফতানি হয়েছে। টি-শার্ট রফতানি হয়েছে ৭২৪ কোটি ডলারের। এছাড়া ৪০৫ কোটি ডলার মূল্যের সোয়েটার, ২০৫ কোটি ডলারের শার্ট ও ব্লাউজ এবং ১৭৯ কোটি ডলার মূল্যের আন্ডার গার্মেন্ট রফতানি হয়েছে। মোট পোশাক রফতানিতে এ পাঁচ পণ্যের অংশ ছিল ৮২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এসব পোশাক উৎপাদনে এখনো মৌলিক অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। মূল্য সংযোজন হচ্ছে কম। ফলে রফতানি পণ্যের দামের সীমাও কেন্দ্রীভূত থাকছে কেজিপ্রতি ১৫ ডলারের মধ্যে।
শ্রম ব্যয় বাড়ায় রফতানিকারকরা এখন ধীরে ধীরে হাই-এন্ডের পোশাক প্রস্তুতের বিষয়ে মনোযোগী হতে শুরু করেছেন বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা। স্নোটেক্স আউটারওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খালেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ মৌলিক পোশাক পণ্যই বেশি তৈরি করে। বিশাল পরিমাণে টি-শার্ট, বটম, শার্টের মতো পণ্যগুলোই আমাদের এখানে বেশি তৈরি হয়। ইদানীং বেশি দামের আউটারওয়্যার অনেকে তৈরি করছে, কিন্তু বাংলাদেশে মূলত মৌলিক পোশাকই বেশি তৈরি হয়। অথচ আমাদের এখানে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ধীরে ধীরে মৌলিক পণ্যের পাশাপাশি হাই-এন্ড পণ্য ভালো পরিমাণে প্রস্তুত করা হবে। এসব পণ্যের রফতানিও বাড়বে। একটি মৌলিক পণ্যের নকশায় সেলাইয়ের কাজ কম। একটি বেসিক মেশিন দিয়ে হাজার পণ্য তৈরি করা যাচ্ছে। কিন্তু যখনই একটি জ্যাকেট, সোয়েটার বা লঞ্জারি তৈরি করা হয় তখন আমাদের পণ্য তৈরিতে মেশিনের ব্যবহার বেড়ে যায়। আবার সেগুলোর পরিমাণও হয় কম। কিন্তু দাম ভালো পাওয়া যায়। এ ধরনের পণ্যে উৎপাদন ক্ষেত্র বা কারখানায় বিনিয়োগ বেশি লাগে। সবাই তাই করতেও পারে না।
এছাড়া ক্রেতাদেশগুলোর সাধারণ ভোক্তাদের সক্ষমতা ও চাহিদা এক্ষেত্রে বড় প্রভাবকের কাজ করে বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, গোটা বিশ্বে অর্থবিত্তের বিচারে ধনী ভোক্তা মোটে ২৫ শতাংশের মতো। হাই-এন্ডের বা বেশি দামের পণ্য মূলত তারাই ক্রয় করেন। বাংলাদেশের প্রস্তুতকারকরা পশ্চিমা দেশগুলোর সাধারণ ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য পণ্য উৎপাদনের ক্রয়াদেশ পান। মূলত শ্রম ব্যয় বিবেচনায় সক্ষমতা ভালো থাকার কারণেই বাংলাদেশ এ কাজগুলো করে। দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা যদি শুধু হাই-এন্ড পণ্য তৈরিতে নিয়োজিত হন, সেক্ষেত্রে দেশে শিল্পোদ্যাগের সংখ্যাও অনেক কমে আসবে।
বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাত্সংযোগ শিল্প শক্তিশালী করা গেলে বাংলাদেশ হাই-এন্ড পণ্যের বাজারে দ্রুতই অবস্থান শক্তিশালী করে নিতে পারবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামভিত্তিক ওয়েল গ্রুপের পরিচালক ও বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমি মনে করি হাই-এন্ড পণ্যের যে বাজার, আমাদের শিল্প মালিকরা সেই ক্রয়াদেশগুলোও নিচ্ছেন এবং রফতানিও করছেন। তবে হাই-এন্ড পণ্যের অংশ এখনো অতটা বেশি নয়। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া হাই-এন্ডের পণ্য বেশি করে। এর কারণও আছে। ওই দেশগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের ভিত অনেক বেশি শক্তিশালী। আমরা চাই আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প আরো শক্তিশালী হয়ে উঠুক। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরাও বড় পরিমাণে হাই-এন্ড পণ্য প্রস্তুতের সক্ষমতা কাজে লাগানোর পথে রয়েছি।
উদ্যোক্তাদের ভাষ্যমতে, এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, ওয়ালমার্টের মতো বড় রিটেইলাররা বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের পণ্যই কেনে। কিন্তু হাই-এন্ড পণ্য কেনে কম। বাংলাদেশের কারখানাগুলোও স্থাপন করা হয় বড় পরিমাণের ক্রয়াদেশকে ঘিরে তৈরি করা মডেলে। ক্রেতাদের ক্রয় কৌশলও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। পশ্চিমা ক্রেতারা তুরস্ক, মরক্কো, গুয়াতেমালা, এল-সালভাদরের মতো দেশ থেকেও পোশাক নিচ্ছে। ওইসব দেশ থেকে মূলত বেশি দামের পণ্যই কিনছে তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেয়া হচ্ছে ক্রেতাদেশগুলোর স্থানীয় জনসাধারণের চাহিদা পূরণের জন্য।
এ বিষয়ে এনএইচটি ফ্যাশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে, কিন্তু ক্রেতারা তাদের সোর্সিং স্ট্র্যাটেজি থেকেই হাই-এন্ডের পণ্য নিচ্ছে কম। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের বাজারে দ্রুত পণ্য পৌঁছাতে পারবে, এমন দেশগুলো থেকেই তারা হাই-এন্ড পণ্য কিনছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই মৌসুমি। বিক্রয়কেন্দ্রে এগুলোর বিক্রির সময়ও কম। বাংলাদেশ থেকে যে পোশাক তারা কিনছে, সেটার ক্রয়াদেশ দেয়া হচ্ছে ১২০ দিন আগে। অন্যদিকে হাই ফ্যাশন পণ্যগুলো দুই সপ্তাহের মধ্যে সোর্সিং করতে হয়। ফলে বাংলাদেশী কারখানাগুলোকে এ ধরনের পণ্যের ক্রয়াদেশ দেয়া ক্রেতার পক্ষে সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান তুরস্কের চেয়ে কম নয়। কিন্তু ক্রেতার প্রত্যাশিত সময়ে পণ্য পৌঁছানো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের বাস্তবতায় সম্ভব না। তুরস্ক থেকে একটি ইউরোপীয় দেশে সড়কপথেও পণ্য পৌঁছানো সম্ভব। তার পরও বাংলাদেশের লিড টাইম কমিয়ে আনার সুযোগ এখনো অনেক। তা করতে পারলে লো-এন্ডের পাশাপাশি হাই-এন্ড এবং হাই ফ্যাশনের বাজারও বাংলাদেশ ধরতে পারবে। এজন্য শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প বড় ভূমিকা রাখবে।
দেশের পোশাক খাতে এখনো বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে হাই-এন্ড পণ্যকে দেখা হচ্ছে বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র হিসেবে। বিজিএমইএ জানিয়েছে, দেশের রফতানি পণ্যের ৭৪ শতাংশ এখনো কটনভিত্তিক। নকশা উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতে হাই-এন্ড পণ্য উৎপাদনে বড় ধরনের বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্প সংগঠনটি।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বিশ্ববাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য দেশের পোশাক শিল্পকারখানাগুলো এখন সিনথেটিক ফাইবার থেকে পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর বাড়াচ্ছে। এ বিষয়টিই বাংলাদেশকে উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য ও নন কটন টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র করে তুলেছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিষয়ে ক্রমেই সচেতনতা বাড়ছে। ভোক্তারাও এখন টেকসই পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। নন কটন পোশাক, বিশেষ করে কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পোশাকের প্রতি ভোক্তাদের মনোযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ আছে। যদি আমরা ফাইবারে বৈচিত্র্য আনার ওপর গুরুত্ব দিই, সেক্ষেত্রে অত্যাধুনিক পণ্য তৈরিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদের যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হবে। উদ্ভাবন, প্যাটার্ন তৈরি, ডিজাইনে অভিনবত্ব আনা, নিজস্ব পণ্য তৈরি, প্রবণতার বিশ্লেষণ, পণ্য বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন প্রভৃতির ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিতে হবে। ডিজাইনের ক্ষেত্রে সক্ষমতা দ্রুত বাড়াতে ভার্চুয়াল ডিজাইন ও প্রোটোটাইপিংয়ের মতো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা অর্জন ও দক্ষতা উন্নয়ন ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করতে হবে।