যেভাবে
প্রত্যাশা করা
হচ্ছে, কলেজ
পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা
সেভাবে অবদান
রাখতে পারছে
না। প্রতি
বছর কলেজ
উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের
মধ্যে একটা
ক্ষুদ্রাংশ মানসম্মত
কর্মের সুযোগ
করে নিতে
পারলেও মোটের
ওপর সেখানকার
পড়াশোনা হয়ে
পড়েছে সনদকেন্দ্রিক।
প্রায় ৩০
বছর আগে
প্রতিষ্ঠিত জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় দেশের
সব কলেজকে
অধিভুক্ত করে।
তার পর
থেকে দেশের
আনাচে-কানাচেও
স্নাতক (সম্মান)
ও স্নাতকোত্তর
শ্রেণীর পাঠদান
শুরু হয়।
এতে
দেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলেও উচ্চশিক্ষা
সম্প্রসারণ হয়েছে।
বিশেষ করে
নারী ও
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর
উচ্চশিক্ষায় অভিগম্যতা
বেড়েছে। ফলে
প্রতি বছর
বিপুল পরিমাণ
উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী
শ্রমবাজারে প্রবেশের
জন্য প্রস্তুত
হচ্ছে। অনেকে
এত বিপুলসংখ্যক
স্নাতকের প্রয়োজন
নিয়ে প্রশ্ন
তুলছেন, কেননা
এদের প্রত্যেকের
অর্জিত জ্ঞান
ও দক্ষতা
কাজে লাগানোর
কর্ম-সুযোগ
নেই। কেউ
কেউ বলেছেন,
এর মাধ্যমে
উচ্চশিক্ষিত বেকার
তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ
উন্নয়ন গবেষণা
প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)
এক জরিপে
বলা হয়েছে,
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে উত্তীর্ণ
স্নাতকদের দুই-তৃতীয়াংশ
বেকার থাকছে।
অন্যদিকে জাবির
অধীনে পরিচালিত
উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে
মানসম্পন্ন মানবসম্পদ
তৈরির সক্ষমতা
নিয়েও প্রশ্ন
উঠেছে। কেননা
কিছু ব্যতিক্রম
ব্যতীত সাধারণত
মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়
ভর্তির পর
অবশিষ্ট অপেক্ষাকৃত
দুর্বল শিক্ষার্থীরাই
অবকাঠামোগতও শিখন-শিক্ষণ-মূল্যায়নের
দুর্বলতা এবং
শিক্ষকস্বল্পতাসহ নানা
সমস্যায় আক্রান্ত
কলেজগুলোয় সম্মান
শ্রেণীতে পড়াশোনা
করে। যেখানে
আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে
মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
ধুঁকছে, সেখানে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
নিয়ে প্রশ্ন
ওঠা স্বাভাবিক।
বর্তমানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধিভুক্ত সাতটি
কলেজ ব্যতীত
বাকি ২
হাজার ২৬৫টি
কলেজের অভিভাবক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
এতগুলো প্রতিষ্ঠানের
চাপে প্রতিষ্ঠানটি
বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ
গ্রহণ না
করে উচ্চশিক্ষা
বোর্ডে পরিণত
হয়েছে। এ
সত্ত্বেও এটির
পক্ষে প্রায়
২৯ লাখ
শিক্ষার্থীর সার্বিক
দেখভাল করা
কঠিন কাজ,
বিশেষ করে
যখন গুণগত
শিক্ষার কথা
ভাবা হয়,
তখন বিষয়টি
আরো কঠিন।
অন্যদিকে অধিভুক্ত
কলেজগুলোয় অপেক্ষাকৃত
দুর্বল ও
সবল প্রতিষ্ঠানগুলো
একই ধরনের
গতানুগতিক কোর্সের
সুযোগ দিয়ে
থাকে, যা
সীমিত সম্পদের
সর্বোত্তম ব্যবহারের
পরিপন্থী। কেননা
অপেক্ষাকৃত সবল
কাঠামোর কলেজগুলো
সমসাময়িক চাকরি
উপযোগী ডিপ্লোমা
ও স্নাতকোত্তর
কোর্স চালু
করার সুযোগ
নিতে পারে।
যেগুলোর মাধ্যমে
তৈরি হতে
পারে উদ্যোক্তা
এবং কারিগরিভাবে
দক্ষ ব্যবস্থাপক
ও মানবসম্পদ।
বিদ্যমান
সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে
উঠলে এবং
নিকট দূরত্ব
থেকে পরিচালনা
করতে পারলে
কলেজগুলোয় মানসম্পন্ন
ও যুগোপযোগী
শিক্ষা নিশ্চিত
করা সম্ভব।
আর এক্ষেত্রে
গুচ্ছ (ক্লাস্টার)
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
একটি সময়োপযোগী
বিকল্প হতে
পারে। গুচ্ছ
বিশ্ববিদ্যালয় বিকেন্দ্রীকরণ
ও ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র একক
গঠনের সঙ্গে
জড়িত। এ
প্রক্রিয়ার ভৌগোলিকভাবে
সন্নিহিত অঞ্চলের
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো
নিজেদের সম্পদের
সর্বোচ্চ ব্যবহার
করে মানসম্পন্ন
শিক্ষার সুযোগ
সৃষ্টি করতে
পারে। উদাহরণস্বরূপ,
আমরা জানি,
কুমিল্লা মহানগরীতে
বৃহত্তম কলেজ
হচ্ছে কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজ।
এছাড়া সরকারি
বেসরকারি মিলে
শহরে আরো
পাঁচ-ছয়টি
কলেজ রয়েছে।
এখন বৃহৎ
কলেজটিকে কেন্দ্র
করে অন্য
কলেজগুলো নিয়ে
একটি গুচ্ছ
গঠন করা
যায়। এ
গুচ্ছটিকে একটি
প্রশাসনিক কাঠামোর
মধ্যে নিয়ে
এসে যে
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
গঠন করা
সম্ভব, সেটিই
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্য সব
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো
সুনির্দিষ্ট আইনের
মাধ্যমে এ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত
ও পরিচালিত
হবে এবং
ডিগ্রি প্রদান
করবে। আচার্য,
উপাচার্য, শিক্ষা
উপদেষ্টা, অর্থ
উপদেষ্টা, রেজিস্ট্রার
ও পরীক্ষা
নিয়ন্ত্রকের পদ
ও অফিস
সৃষ্টির প্রয়োজন
পড়বে। প্রযুক্তিবান্ধব
পরিবেশে বড়
প্রতিষ্ঠানটি এতে
নেতৃত্ব দেবে
আর অন্য
প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের
অংশ হিসেবে
শিক্ষা কার্যক্রমকে
এগিয়ে নিয়ে
যাবে।
গুচ্ছ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা
বহু। প্রথমত,
শিক্ষকরা নতুন
কোর্স চালু,
শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যসূচি প্রণয়নে
স্বায়ত্তশাসন ভোগ
করবেন। ফলে
দ্রুততম সময়ের
মধ্যে শিক্ষার্থীদের
ক্যারিয়ার উপযোগী
কোর্স চালু
করা যাবে।
একইভাবে শিখন-শিক্ষণ
পদ্ধতি নিরূপণে
শিক্ষকদের সুযোগ
বৃদ্ধি পাবে।
অধিকন্তু, শিক্ষার্থী
মূল্যায়নের উপকরণ
নির্ধারণ, শিখন-শিক্ষণ
কার্যক্রমের সঙ্গে
মূল্যায়নের সম্পর্ক
প্রতিষ্ঠা এবং
মূল্যায়নে শিক্ষকদের
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত
হবে। এছাড়া
শিক্ষার্থী ভর্তিতেও
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়
মানদণ্ড ঠিক
করা ও
বাছাই প্রক্রিয়া
নিষ্পন্ন করতে
পারবে। বর্তমান
কাঠামোয় শিক্ষকদের
এসবের ওপর
ভূমিকা নেই।
দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোর
অবকাঠামো ও
সম্পদের সহযোগিতামূলক
ব্যবহারের মাধ্যমে
এসবের সর্বোত্তম
ব্যবহার নিশ্চিত
হবে। উদাহরণস্বরূপ,
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের
সব ক্যাম্পাসে
সব ধরনের
কোর্স না
পড়িয়ে কোনো
একটি কলেজে
শুধু ব্যবসায়
শিক্ষার কোর্সগুলো
রাখা যেতে
পারে। আবার
কোনোটিতে হয়তো
সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলো
পড়ানো যেতে
পারে। তৃতীয়ত,
বিভিন্ন সেমিস্টারে
শিক্ষার্থীদের তাদের
পছন্দানুযায়ী কোর্স
অধ্যয়নের সুযোগ
দেয়া যেতে
পারে। যেমন
কোনো শিক্ষার্থী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স
পড়ছে। সপ্তম
সেমিস্টারে তার
মনে হলো,
সে ১০০-২০০
নম্বরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
কোর্সের পরিবর্তে
ব্যবস্থাপনার একটি
ও ইংরেজির
একটি কোর্স
নিতে আগ্রহী
এবং তাকে
তা নেয়ার
সুযোগ দেয়া
যেতে পারে।
চতুর্থত, বর্তমানে
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা
অপরাধের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিতে
দেখা যায়
না। যেমন
কোনো শিক্ষার্থী
বর্তমানে জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে
একদিনও ক্লাস
না করে,
কোনো বাধা
না পেয়ে
চার বছরের
স্নাতক ডিগ্রি
অর্জন করতে
পারে, যা
হওয়া উচিত
নয়। পঞ্চমত,
ঘনিষ্ঠভাবে সব
কার্যক্রমের তদারকি
সম্ভব, যা
শিক্ষার গুণগত
মান বৃদ্ধিতে
সহায়তা করবে।
ষষ্ঠত, এ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়
অনেক কিছু
নতুন করে
নির্মাণ করতে
হবে না।
কেননা যে
কলেজগুলো নিয়ে
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠিত হবে,
সেখানের প্রায়
প্রতিটিতে নানা
ধরনের অবকাঠামো
বর্তমান। সপ্তমত,
শিক্ষা ক্যাডারের
সদস্যদের দ্বারা
এ বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালিত হতে
পারে, যাদের
নিয়োগ প্রক্রিয়া
নির্ধারিত। বর্তমানে
এ ক্যাডারের
অনেক সদস্য
দেশে-বিদেশে
উচ্চশিক্ষা গ্রহণ
করে তা
কাজে লাগানোর
সুযোগ পাচ্ছে
না। অষ্টমত,
প্রান্তিক পর্যায়ে
গবেষণা কার্যক্রমের
বিস্তৃতির সুযোগ
সৃষ্টি হবে,
যা বর্তমানে
কলেজগুলোয় নেই
বললেই চলে।
গুচ্ছ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়
বেশকিছু চ্যালেঞ্জ
রয়েছে। প্রথমত,
বেশকিছু নতুন
অবকাঠামো ও
কর্মকর্তার পদ
তৈরির প্রয়োজন
হবে। দ্বিতীয়ত,
নৈতিকভাবে কঠোর
মান নিয়ন্ত্রণের
ব্যবস্থা করতে
হবে। তৃতীয়ত,
সময়োপযোগী বিভিন্ন
কোর্স ও
পাঠ্যসূচি চালু
করার জন্য
দেশের শিল্প
ও ব্যবসায়
প্রতিষ্ঠান ও
বিদেশের বাজারের
চাহিদার সঙ্গে
নিবিড়ভাবে কাজ
করতে হবে।
চতুর্থত, মানসম্পন্ন
শিক্ষা নিশ্চিতে
শিক্ষার্থী ভর্তি
কমিয়ে আনতে
হবে এবং
শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পড়াশোনা
ও মূল্যায়ন
চালু করতে
হবে। পঞ্চমত,
গবেষণা খাতে
যথেষ্ট পরিমাণে
অর্থ বরাদ্দ
করতে হবে।
পরিশেষে
বলতে হয়,
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠায় সরকার,
ইউজিসি ও
স্থানীয় জনসমাজকে
আন্তরিকভাবে এগিয়ে
আসতে হবে।
সনদনির্ভর পড়াশোনা
থেকে বের
হয়ে মানসম্মত
শিক্ষা নিশ্চিতে
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়
হতে পারে
এক অনন্য
উদ্যোগ।
ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার: শিক্ষক ও গবেষক