ওমিক্রন সংক্রমিত দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ

করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়া হোক

করোনা প্রতিরোধে সুখবর মিলেছিল কয়েক দিন আগেই। মৃত্যু শনাক্ত কমে এসেছে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, করোনার ভয়ংকর এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ছে। আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রন। এটিকে খুবই অ্যাগ্রেসিভ ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে ওমিক্রন প্রতিরোধে নানা ব্যবস্থায়। ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে প্রবেশ রোধে কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছে সরকারও। করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটি সংক্রমিত দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট বিদেশ থেকেই প্রবেশ করেছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনাপূর্বক দ্রুতই জাতীয় কমিটির পরামর্শ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। করোনার এই নতুন ধরন নিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে এখন থেকেই। শুধু কাগজে-কলমে ব্যবস্থা নয়, বাস্তবেও তার প্রতিফলন থাকা চাই। 

গত বছর অক্টোবরেও ভারতে নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছিল। ডেল্টা নামের ওই ধরন অতিদ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের সতর্কতায় এটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে করোনার মতো দীর্ঘস্থায়ী মহামারী মোকাবেলা করা সহজ কাজ নয়। একদিকে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, অন্যদিকে জীবিকা রক্ষার চেষ্টা করাসব মিলিয়ে যেকোনো সরকারের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরও বাংলাদেশ বড় ট্র্যাজেডি এড়াতে পেরেছে। কারণ অনেক দেশে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ পর্যন্ত সংক্রমণ মোকাবেলায় অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো করেছে। এটি পরীক্ষিত যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে কম মূল্য দিতে হয় এবং সহজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু বিলম্বিত পদক্ষেপে জীবনের মূল্য দিতে হয় এবং কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রশ্ন হতে পারে, কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ উপযুক্ত হবে। যদিও যুক্তরাজ্য অন্যান্য দেশ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ফ্লাইট স্থগিত করে দিয়েছে; কিন্তু এটিও সত্য যে এরই মধ্যে ভ্যারিয়েন্টটি ওই দেশগুলোর বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, দক্ষিণ আফ্রিকা নতুন ধরন শনাক্তে যে দক্ষতা স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে, পরিবহন সংযোগ বন্ধ করে এখন তাকে শুধু এর শাস্তিই দেয়া হচ্ছে। অথচ এমন একটি ধরনের উদ্ভব অন্য কোথাও হতে পারে। এমন সন্দেহও রয়েছে যে ধরনটি যদি ইউরোপ বা আমেরিকায় উদ্ভব হতো, তাহলে পদক্ষেপ ধীরলয়েই হতো। যা- হোক, ভ্রমণ স্থগিত ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার আটকাতে পারে না। কেউ কেউ মনে করেন, আরো বেশি বেশি টিকা প্রদান, জনসচেতনতা বৃদ্ধি শক্তিশালী রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে আরো মূল্যবান সময় ব্যয় করা দরকার। বিচার-বিবেচনা করেই সময়টি ব্যয় করতে হবে। বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার বিষয়টি কখনই শিথিল করা যাবে না। নীতিনির্ধারকদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। বছরের মে মাসে দ্বিতীয়বার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দিতে হয়েছিল, আগস্টে তা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু হতাশার বিষয় লকডাউন শিথিল ছিল, যার কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা হওয়ার কথা ছিল না। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় হলো এর ছড়িয়ে পড়া রোধ করা। ভাইরাস মানুষের মধ্যে বেড়ে ওঠে, মানুষই একে বহন করে এবং মানুষের মাধ্যমেই এটি ছড়ায়। তাই সবার আগে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নতুন ভ্যারিয়েন্টটি যাতে দেশে প্রবেশ না করতে পারে।

করোনার নতুন ধরন মোকাবেলায় এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর জাপান কোয়ারেন্টিন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের জোটভুক্ত সব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবেলায় ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বতসোয়ানা হংকংয়েও করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা বতসোয়ানা থেকে আরো অনেক দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করলেই করোনার নতুন ধরন ঠেকানো যাবে না। নতুন ধরনের করোনায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি অন্য দেশ থেকেও বাংলাদেশে আসতে পারেন। বাংলাদেশের প্রথম কর্তব্য হবে বিমানবন্দরসহ সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং বাড়ানো, আগত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন দেশের ভেতরে কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করতে পারে। প্রবেশপথে শনাক্ত করতে না পারা ঢিলেঢালা কোয়ারেন্টিনের কারণেই ডেল্টা ধরন দ্রুত দেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবার যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি চারটি সুপারিশ করেছে। এসবই ভালো উদ্যোগ কিন্তু প্রশ্ন হলো, মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন করবে কে? এর আগেও এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নে শিথিলতার কারণে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এর পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। করোনাবিষয়ক কমিটিগুলো নিয়মিত বৈঠক করে না বা সভা ডাকা হয় না। আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল গত বছর অক্টোবরে। অন্যদিকে রোগতত্ত্ব জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সর্বশেষ সভা হয় বছর ফেব্রুয়ারিতে। এসব কমিটি করোনাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক তথ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরকারকে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিত। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ঢোকার নির্দিষ্ট স্থানগুলোয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেসব স্থানে পরীক্ষা জোরদার করার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ এলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে টিকাদানের চিত্র হতাশাজনক। মাত্র ২০-২২ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে, যদিও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ শতাংশ। অবস্থায় করোনার ধরন পরীক্ষা করতে দ্রুত জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকার সংগ্রহ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে যে শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, তাও দূর করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্য দেশগুলোকে চারটি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি নতুন ধরনটি সম্পর্কে জানতে জিন বিশ্লেষণ করতে হবে; পূর্ণাঙ্গ জিন বিশ্লেষণের তথ্য সর্বসাধারণের জানার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে; নতুন রোগী শনাক্ত হলে বা সংক্রমণ গুচ্ছাকার ধারণ করলে তা বিশ্ব সংস্থাকে জানাতে হবে এবং নতুন ধরনের সংক্রমণের তীব্রতা, রোগ নির্ণয় পদ্ধতিসহ বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য সামাজিক উদ্যোগের কার্যকারিতা বোঝার জন্য কাজে সমন্বয় বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলেছে, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলার পাশাপাশি টিকা নেয়া অব্যাহত রাখতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের উচিত সময় এলে স্বাস্থ্য অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরপূর্বক প্রয়োগ করা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ভালোভাবে প্রস্তুত করা এবং এজন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মানবসম্পদ উভয় ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা, যাতে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এর সামাল দিতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন