আমার জানা
সাম্প্রতিক ইতিহাসের
পাতা থেকে
আজ আপনাদের
জন্য আমি
তুলে এনেছি
১০ বছর
আগের একটি
বেদনাবিধুর ও
চমকপ্রদ বিদেশী
গল্প। রূপকথার
মতো শোনালেও
এটি একটি
সত্য ঘটনা।
এ যে
মানুষের জীবনের
কথা বলে,
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
ও উপলব্ধির
কথা বলে।
সর্বোপরি কঠিন
ও করুণ
বাস্তবতার চাদরে
মোড়ানো এ
যে এক
রোমহর্ষক কাহিনী।
যেদিনের কথা
বলছি, সেদিন
সকালবেলা অফিসে
গিয়ে কম্পিউটার
খুলে দেখি
আচমকা এক
ই-মেইল
এসেছে দক্ষিণ
কোরিয়া থেকে।
লিখেছেন শামসুদ্দিন
আহমেদ নামে
একজন প্রবাসী
বাংলাদেশী। বলে
রাখি, শামসুদ্দিন
সাহেবের সঙ্গে
আমার আগের
কোনো পরিচয়
নেই, জানাশোনা
নেই। তিনি
কীভাবে আমার
সন্ধান পেলেন—আল্লাহ
মালুম। ই-মেইলের
সঙ্গে আমার
নতুন বন্ধু
একটি আলাদা
ফাইলও সংযুক্ত
করেছেন। ফাইলটি
খুলে দেখি,
এটি একটি
নাতিদীর্ঘ চিঠি।
চিঠিটি ‘নিউ
আমেরিকা মিডিয়ায়’
(কী কারণে
জানি না,
তবে ২০১৭
সালে এ
সংবাদমাধ্যম ব্যবসা
গুটিয়ে নিয়েছে)
প্রকাশিত হয়েছে
১৯ মার্চ,
২০১১। জাপানে
ঘটে যাওয়া
‘সেন্ডাই ভূমিকম্প’,
তত্পরবর্তী সুনামি
ও ‘ফুকুশিমা
পারমাণবিক বিপর্যয়’
শুরু হওয়ার
কয়েক দিন
পর চিঠিটি
লিখেছিলেন ফুকুশিমায়
কর্মরত একজন
ভিয়েতনামি অভিবাসী,
যিনি জাপানে
থাকেন এবং
সে দেশের
পুলিশ বিভাগে
চাকরি করেন।
পুলিশ অফিসারের
নাম ‘হা-মিন
থান’।
হা-মিন
পত্রটি লিখেছেন
তার এক
স্বদেশী বন্ধুকে—সম্বোধন
করেছেন ‘ভাই’
বলে। প্রকাশিত
হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গেই চিঠিটি
ফেসবুকের মাধ্যমে
পৌঁছে যায়
বিদেশে অবস্থানরত
লাখ লাখ
ভিয়েতনামির ঘরে
ঘরে। তারপর
এ চিঠি
কম্পিউটারের পর্দা
থেকে পর্দায়
বেশ কিছুদিন
ঘুরে বেড়ানোর
পর শামসুদ্দিন
আহমেদের বদান্যতায়
ওইদিন আমার
হাতে এসে
পৌঁছে। সেদিনের
দিন-তারিখ
এখন আর
মনে নেই।
চিঠিটির বিষয়বস্তু
ও তার
মর্মকথা নিয়েই
রচিত হয়েছে
আমার আজকের
এই বিষণ্ন
বিবরণ। পাঠকদের
মনে থাকার
কথা, ২০১১
সালের ১১
মার্চ ভূমিকম্প
ও সুনামির
ফলে জাপানের
ফুকুশিমা পারমাণবিক
স্থাপনার ছয়টি
চুল্লির মধ্যে
চারটিই ভেঙে
পড়ে। ভূমিকম্প,
সুনামি ও
পারমাণবিক বিপর্যয়ের
ফলে ফুকুশিমা
ও তার
আশপাশের মানুষ,
পশুপাখি, গাছপালা
ও পরিবেশের
ওপর সেদিন
নেমে এসেছিল
এক ঐতিহাসিক
ধ্বংসলীলা। চিঠিতে
এ দুর্ঘটনার
ও জনদুর্ভোগের
এক হূদয়স্পর্শী
বর্ণনা পাওয়া
যায়। হা-মিন
লিখেছেন, দুর্যোগের
অব্যবহিত পরে
দুর্গত মানুষের
সেবা, সাহায্য
ও উদ্ধারকাজে
তারা দৈনিক
২০ ঘণ্টা
করে কাজ
করেছেন। তার
পরও তার
কাছে মনে
হয়েছে, প্রয়োজনের
তুলনায় ত্রাণ
তত্পরতা খুবই
অপ্রতুল। মানুষ
দিনের পর
দিন সীমাহীন
দুর্ভোগের মধ্যে
প্রতি মুহূর্তে
জীবন-মৃত্যুর
সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে
বাঁচার সংগ্রাম
চালিয়ে গেছে।
উদ্ধারকাজের সেবা
ও মানুষের
প্রয়োজনীয় সহায়তা
পর্যাপ্ত পরিমাণে
শারীরিক ও
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত
লোকদের কাছে
পৌঁছানো সম্ভব
হচ্ছিল না।
পানি নেই,
বিদ্যুত্ পুরোপুরি
বিপর্যস্ত, যোগাযোগ
ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড।
ভুক্তভোগী মানুষ
ও উদ্ধারকর্মী
সবার জন্য
খাবারের রেশন
দ্রুত ফুরিয়ে
যাচ্ছিল। এমন
অবস্থায় জীবিত
মানুষগুলোর জীবন
কেটেছিল একদিন
একদিন করে।
সার্বিক অবস্থা
এতটাই অনিশ্চিত
ও ভয়াবহ
রূপ ধারণ
করেছিল যে
একদিন বেঁচে
আছে তো
পরদিন থাকবে
কিনা, কারো
জন্যই তার
কোনো নিশ্চয়তা
ছিল না।
পুলিশ অফিসারটি
আরো লিখেছেন,
মানুষের মরদেহ
ঘাঁটাঘাঁটি করতে
করতে এমন
হয়েছিল, চোখ
খুললেই তিনি
দেখতে পেতেন
শুধু মরদেহ
আর মরদেহ।
চোখ বন্ধ
করলেও চারদিকে
দেখতেন, মরা
মানুষের মিছিল।
তার অবস্থান
এবং কর্মক্ষেত্র
ছিল ফুকুশিমা
থেকে মাত্র
২৫ কিলোমিটার
দূরে। উদ্ধারকাজের
সময় একদিন
তার সঙ্গে
দেখা হয়েছিল
ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত
এক মার্কিন
প্রকৌশলীর, যার
নাম টোয়া।
টোয়া ফুকুশিমা
পারমাণবিক জ্বালানি
স্থাপনার কোনো
এক চুল্লিতে
কাজ করতেন।
তিনি শরীরের
বিভিন্ন জায়গায়
মারাত্মক জখম
নিয়ে যন্ত্রণায়
কাতরাচ্ছিলেন। পরিচয়
পেয়েই হা-মিন
সঙ্গে সঙ্গে
টোকিওতে অবস্থিত
মার্কিন দূতাবাসে
ফোন করেন।
দূতাবাস কর্তৃপক্ষ
জরুরি ভিত্তিতে
হেলিকপ্টার পাঠিয়ে
টোয়াকে নিকটবর্তী
আমেরিকান সামরিক
হাসপাতালে স্থানান্তর
করে।
হা-মিনের
জানামতে, ওই
অঞ্চলে কয়েকজন
ভিয়েতনামি ছাত্রছাত্রী
থাকত কিন্তু
ঠিকানা না
জানায় পুলিশ
অফিসার হয়েও
তাদের ভাগ্য
জানার কোনো
উপায় হয়নি
তার। জাপানে
‘একান্ততা সুরক্ষা’
আইনের কড়াকড়ির
কারণে অন্য
দেশের মতো
পুলিশের কাছে
কারো নাম-ঠিকানা
থাকে না।
ফলে ওই
শিক্ষার্থীদের কোনো
হদিস পাওয়া
গেল না
তো গেলই
না।
সাগরসৈকত থেকে
মাত্র তিন
কিলোমিটার ভেতরে
থাকতেন এক
জাপানি নারী।
তার নাম
‘নাগোয়েন থি
হুয়েন’।
তিনি ১১
জন ভিয়েতনামি
নারীর একটি
দলের সঙ্গে
কাজ করতেন।
সুনামির সময়
নাগোয়েন যখন
দৌড়ে পালাচ্ছিলেন,
তখন ভিয়েতনামি
নারীরাও বাঁচার
জন্য তাকে
অনুসরণ করে
প্রাণপণে ছুটছিলেন
নাগোয়েনের পিছে
পিছে। অনেক
দূর পর্যন্ত
তারা তাদের
জাপানি মেন্টরকে
অনুসরণও করেছিলেন।
কিন্তু শেষ
পর্যন্ত তাদের
একজনেরও প্রাণরক্ষা
হয়নি। নিরাপদ
স্থানে এসে
নাগোয়েন যখন
পেছন ফিরে
তাকালেন, তখন
আর কাউকে
দেখতে পেলেন
না। হা-মিন
দুঃখ করে
লিখেছেন, জানার
পরও টোকিওর
ভিয়েতনামি দূতাবাস
তাদের এই
হারিয়ে যাওয়া
নাগরিকদের জন্য
তেমন কোনো
উদ্যোগই নেয়নি।
পানি ও
বিদ্যুতের অভাব,
খাবারের স্বল্পতার
সঙ্গে সঙ্গে
ঠাণ্ডার কারণে
মানুষের দুর্ভোগজনিত
যন্ত্রণা বেড়ে
গিয়েছিল বহুগুণ।
দিনে সহনীয়
হলেও রাতে
ঠাণ্ডা নেমে
আসত হিমাঙ্কের
কাছাকাছি। খাদ্য
ও পানীয়ের
সঙ্গে শীতবস্ত্রের
অভাবে মানুষ
হয়ে উঠছিল
দিশেহারা। তখন
অবস্থা এতই
নাজুক ছিল
যে উদ্ধারকর্মী
ও পুলিশ
কর্মকর্তারাও ন্যূনতম
খাবার ও
পানীয়ের জন্য
হা-পিত্যেশ
করছিলেন। এত
দুঃখ ও
দুর্দশার মধ্যেও
জাপানিরা একটুও
ধৈর্যহারা হননি
এবং শৃঙ্খলারও
কোনো ব্যত্যয়
ঘটাননি। এ
রকম বিপদের
সময়েও তাদের
আত্মসংবরণ এবং
আত্মমর্যাদা দেখে
হা-মিন
বিস্মিত ও
অভিভূত না
হয়ে পারেননি।
তারপর পুলিশ
অফিসার হা-মিন
অলৌকিকভাবে একজন
মানবদরদি কথাশিল্পী
হিসেবে আবির্ভূত
হলেন এবং
রচনা করলেন
তার চিঠির
কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত
নয় বছরের
এক ক্ষুদ্র
জাপানি বালকের
অভূতপূর্ব চরিত্র।
হা-মিনের
ওই বালক
আবিষ্কার ও
তার চরিত্র
বর্ণনা গল্প-উপন্যাসকেও
হার মানায়।
চিঠিতে হা-মিন
ছেলেটির নাম
উল্লেখ করেননি।
আলোচনার সুবিধার
জন্য ধরুন
আমরা তার
নাম দিলাম
‘আসাহি’।
হা-মিন
আসাহির গভীর
মানবতাবোধ ও
চরম আত্মত্যাগের
ঘটনা বিবৃত
করে বিশ্ববাসীকে
রীতিমতো স্তম্ভিত
করে দিলেন।
অভিবাসী পুলিশ
অফিসারের বর্ণনা
অনুযায়ী উদ্ধারকাজ
চলাকালীন একদিন
রাতে তিনি
গিয়েছিলেন উপদ্রুত
এলাকার এক
‘গ্রামার স্কুল’-এ,
যেখানে বেশকিছু
দুর্গত শরণার্থী
আশ্রয় নিয়েছিল।
ওইদিন রাতে
আশ্রয়কেন্দ্রে শরণার্থীদের
মধ্যে খাদ্য
বিতরণের কাজ
চলছিল। হা-মিন
ছিলেন সেখানকার
কর্তব্যরত পুলিশ
অফিসার। ত্রাণ
নিতে আসা
শরণার্থীদের লাইন
ছিল অনেক
লম্বা। লাইনের
একেবারে শেষ
মাথায় দাঁড়িয়েছিল
আসাহি। তার
গায়ে ছিল
একটি টি-শার্ট
এবং পরনে
হাফ প্যান্ট।
ঠাণ্ডায় ছেলেটি
থরথর করে
কাঁপছিল। হা-মিন
তার কাছে
গিয়ে নিজের
পরনের জ্যাকেটটি
খুলে ছেলেটির
গায়ে পরিয়ে
দিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন তার
মায়ের কথা।
আসাহি বলল,
তার বাড়ি
একেবারে সাগরতীরে—মা
ও ছোট্ট
বোনটির কথা
সে কিছুই
জানে না।
সম্ভবত তারা
দুজনই ভেসে
গেছে সাগরের
নোনা জলে।
বলতে বলতে
সে চোখের
পানি মুছল।
হা-মিনকে
সে আরো
বলল, যখন
ভূমিকম্প হানা
দেয় তখন
সে স্কুলে
পি.ই.
ক্লাসে ছিল।
সুনামি আসার
ঠিক আগে
আগে স্কুল
বিল্ডিংয়ের তিনতলার
ব্যালকনিতে ছিল
তার অবস্থান।
তার বাবা
খুব কাছেই
কাজ করতেন।
খবর পেয়ে
তিনি গাড়ি
চালিয়ে তাকে
নিতে স্কুলের
দিকে আসছিলেন।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে আসাহি
দেখছিল—কীভাবে
তার বাবার
গাড়িখানা হঠাত্
ফুলে ওঠা
সাগরের পানির
ঢেউয়ে উল্টে-পাল্টে
খাবি খেতে
খেতে জোয়ারের
পানিতে অদৃশ্য
হয়ে গেল।
কীভাবে সদ্য
প্রিয়জনহারা আসাহিকে
সান্ত্বনা দেবেন,
হা-মিন
কিছুই বুঝে
উঠতে পারছিলেন
না। এদিকে
বিতরণযোগ্য খাদ্যের
মজুদ দ্রুত
ফুরিয়ে যাচ্ছে।
হা-মিন
আন্দাজ করলেন,
লাইনের শেষে
আসার আগেই
খাবার শেষ
হয়ে যাবে।
ছেলেটির ভাগ্যে
কিছুই জুটবে
না। মা-বাবা
হারিয়ে অবোধ
অনাথ বালক
রাতে উপোস
করবে, হা-মিনের
তা সহ্য
হচ্ছিল না।
তিনি তার
নিজের খাবার
প্যাকেট ছেলেটির
দিকে এগিয়ে
দিয়ে বললেন,
‘তোমার কাছে
আসতে আসতে
সব শেষ
হয়ে যাবে।
তুমি এটা
খাও, আমি
খেয়েছি।’
ছেলেটি প্যাকেট
নিয়ে মাথা
নামিয়ে জাপানি
কায়দায় ‘বাও
ডাউন’
করে ধন্যবাদ
দিল এবং
কিছুই না
খেয়ে লাইনের
সামনে গিয়ে
খাবারের ঝুড়ির
মধ্যে প্যাকেটটি
রেখে দিয়ে
লাইনের শেষে
এসে যথারীতি
আবার তার
আগের জায়গায়
দাঁড়িয়ে গেল।
হা-মিন
অবাক হয়ে
তাকে জিজ্ঞেস
করলেন, ‘তুমি
কিছুই না
খেয়ে ওখানে
নিয়ে প্যাকেটটি
রেখে দিলে
কেন?’ বালক
আসাহি উত্তর
দিল, ‘আমার
চেয়েও বেশি
ক্ষুধার্থ কেউ
আমার সামনে
লাইনে থাকতে
পারেন। আমার
আগে তো
তারই পাওয়া
উচিত।’
হা-মিনের
মাথা লজ্জায়
হেঁট হয়ে
এল। তিনি
বললেন, যে
সমাজ, সামাজিক
মূল্যবোধ ও
শিক্ষা ব্যবস্থা
বছরের একটি
ছেলেকে এমন
উন্নত মানবতাবোধ
ও আত্মত্যাগ
শিক্ষা দিতে
পারে, সে
সমাজের ক্ষয়
নেই, সে
জাতির পরাজয়
নেই।
জাপানি ভাষায়
আসাহি শব্দের
অর্থ ‘সূর্যের
আলো’।
আমার দৃঢ়
বিশ্বাস, আসাহি
বেঁচে আছে
এবং সে
আজ ১৯
বছরের একজন
টগবগে তরুণ।
অন্ধকারে নিমজ্জিত
জগতের সব
মানুষের ঘরে
ঘরে সূর্যের
উত্তাপ ছড়িয়ে
দেয়ার জন্য
আসাহি যেন
দীর্ঘদিন বেঁচে
থাকে। আজকের
দিনে মহান
আল্লাহর কাছে
এই আমার
ঐকান্তিক কামনা।
আবু এন
এম ওয়াহিদ:
অধ্যাপক, টেনেসি
স্টেট ইউনিভার্সিটি
ম্যানেজিং এডিটর:
জার্নাল অব
ডেভেলপিং এরিয়াজ