ইইউর জিএসপি সুবিধা নেয়া বন্ধে চীনের ঘোষণায় বাংলাদেশে সৃষ্ট বিনিয়োগ স্থানান্তরের সম্ভাবনা

সুযোগ কাজে লাগাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক

বেশ কয়েক বছর ধরে ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোয় চীনের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা চলছে। নানা কারণে বেইজিংও এর সঙ্গে অনেকটা সম্মত বলে জানা গেছে। এমন এক বাস্তবতায় সম্প্রতি দেশটির সরকার স্থানীয় রফতানিকারকদের জন্য সার্টিফিকেট অব অরিজিন (সিও) ইস্যু বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সনদ না থাকায় স্বভাবত দেশটির রফতানিকারকরা এখন থেকে ইইউর জিএসপি সুবিধা পাবেন না। দেশটির নতুন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের জন্য বড় মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বলছেন পর্যবেক্ষকরা। কাজেই উদ্ভূত সুযোগ কাজে লাগাতে রাষ্ট্রের আরো উদ্যোগী ভূমিকা সহায়ক পরিবেশ বিনির্মাণ জরুরি।

১৯৭৮ সালে চীন নিজেকে বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে জিএসপির অধীনে ৪০টি দেশে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেয়ে আসছে দেশটি। বাড়তে থাকে বাণিজ্য। এর মধ্যে ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্যভুক্ত হলে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য আরো গতি পায়। সুবাদে গত কয়েক দশকে দেশটির অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীর্ষ অর্থনীতি হওয়ার প্রতিযোগিতা করছে তারা। যদিও কাগজে-কলমে চীন এখনো রয়ে গেছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। এটা নিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে নানা সমালোচনা হচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা পড়ছে প্রশ্নের মুখে। দ্রুত আগুয়ান রাষ্ট্র হিসেবে দেশটির তৈরি হচ্ছে ভাবমূর্তি সংকট। তদুপরি দেশটিতে অনেক দিন ধরে শ্রমমূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিরাজমান। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে, বাড়ছে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়, কমছে দেশটির আপেক্ষিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। ফলে অনেক শিল্প, বিশেষ করে শ্রমনিবিড় শিল্পগুলো অন্যত্র স্থানান্তরে উৎসাহিত হচ্ছে। সর্বোপরি চীনের নীতিনির্ধারকরা বর্তমানে ভারী উদ্ভাবনী শিল্পের ওপর বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। চলমান বিদ্যুৎ সংকটের কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে ছোটখাটো শিল্প থেকে সরে আসার নীতি। সব মিলিয়ে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে ইউরোপে জিএসপির বিপরীতে সিও সনদ বন্ধের ঘোষণাটি এসেছে।

পরিবর্তিত বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ দৃশ্যপটে চীনের শিল্প-কারখানাগুলো অন্যত্র স্থানান্তর শুরু হয়েছে ২০১৫ সালের পর। কিছু শিল্প-কারখানা এরই মধ্যে ভিয়েতনামে স্থানান্তর হয়েছে। কিছু কারখানা কম্বোডিয়া, লাওসে মিয়ানমারে স্থানান্তর হয়েছে। সিও বন্ধের সাম্প্রতিক ঘোষণায় দেশটি থেকে বিনিয়োগ স্থানান্তর আরো গতিশীল হয়ে উঠবে বৈকি। এটা মাথায় রেখে প্রতিবেশী ভারতসহ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণকারী প্রতিযোগী দেশগুলো ভৌত নীতিগত নানা পরিবর্তন আনছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়াচ্ছে। করপোরেট কর, শুল্ক কর অভিঘাত কমাচ্ছে। কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। বিদেশী পুঁজি শতভাগ প্রত্যাহারের সুযোগ রেখে আইনি সংস্কার করছে। সর্বোপরি বিনিয়োগের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে। উল্লিখিত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

এর আগেও দেশে চীন থেকে বিনিয়োগ স্থানান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। ফলে অনেক বড় প্রকল্প অন্যত্র চলে গেছে। এখন নতুন করে বড় ধরনের যে বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটিকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে আবারো সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বলা হচ্ছে, দেশে শিল্প দক্ষতা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখনো বেশ কম। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে এক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে হবে। এজন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ আরো জোরদার করা জরুরি। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তিও একটা বড় বিষয়। যথার্থভাবেই উদ্যোক্তাদের ভাষ্যে উঠে এসেছে যে ভাবমূর্তিতে কোনো রকম সংকট দেখা দিলে নতুনভাবে সৃষ্ট সম্ভাবনা কাজে লাগানো ব্যাহত হবে। কাজেই এদিকে নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে বৈকি।

সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে নানাভাবে চেষ্টা করছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করছে। যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদেশী উদ্যোক্তাদেরও দেয়া হচ্ছে। তবু আশানুরূপ বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না। কাজেই কেন আসছে না, তার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর কী কী বাধা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত নিরসন করতে হবে। বিশেষ করে নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আরো বেশি কৌশলী হতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার অনুযায়ী প্রকল্প নিতে হবে। দেশের বস্ত্র পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ এখন প্রয়োজন। খাতে কৃত্রিম তন্তুর মতো উচ্চমাত্রায় মূল্য সংযোজনকারী পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় শূন্য বলা চলে। প্রেক্ষাপটে উচ্চমাত্রায় মূল্য সংযোজনে সক্ষম বিনিয়োগ প্রকল্প এখন বাংলাদেশের জন্য সময়ের দাবি। চীনের সাম্প্রতিক ঘোষণাকে পোশাক বস্ত্র খাতের কাঠামোগত বিন্যাসে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। উল্লিখিত দুটি খাত ছাড়াও বাণিজ্য, নির্মাণ, চামড়া চামড়াজাত পণ্য এবং কেমিক্যাল-ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে চীন থেকে স্থানান্তর হওয়া বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এটাকে কাজে লাগাতে যথাযথভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের বড় দুর্বলতা হলো, কাগজ-কলমে বিদেশীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সেগুলো সম্পর্কে তারা খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। সম্পর্কে কীভাবে বিদেশী বিশেষ করে চীন থেকে স্থানান্তরে আগ্রহী শিল্পোদ্যোক্তাদের অবহিত করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ব্যবসায়ী সংগঠন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রয়োজনে দেশটিতে ইনভেস্টমেন্ট কনফারেন্সের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ অনুমোদন করেছে জাতিসংঘ। রূপান্তর পর্যায় শেষে সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক বাণিজ্য সুবিধা সীমিত হয়ে যাবে। সুতরাং টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে শিল্প খাতে আমাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটা মাথায় রাখা চাই। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমূলক বাংলাদেশের কিছু অন্তর্নিহিত শক্তির জায়গা বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ বা বহিস্থ বড় ধরনের গোলযোগ কিংবা উত্তেজনা ছাড়া আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমজাতীয়। এখানকার জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকূলতার মুখে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম। তদুপরি ক্ষুদ্র দলীয় গণ্ডির বাইরে বাজারমুখী সংস্কারের প্রতি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমর্থন এখানে বিরাজমান। সর্বোপরি এখানে রয়েছে প্রশিক্ষণযোগ্য, উদ্যমী, পরিশ্রমী নিম্নব্যয়ের বিপুল শ্রমশক্তি। শক্তির ক্ষেত্রগুলো বিদেশীদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে এবং অব্যাহতভাবে চালাতে হবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি বিনির্মাণ করতে হবে একটা সহায়ক পরিবেশ। সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় চীন থেকে বিনিয়োগ স্থানান্তর ত্বরান্বিত হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন