এক দশক পর গ্যাসের চাহিদার ৮৫% মেটাতে হবে আমদানি করে

আবু তাহের

সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে দেশের শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোয় চাহিদা আরো বাড়বে বলে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রক্ষেপণে উঠে এসেছে। তবে জ্বালানি পণ্যটির চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে সরবরাহ বাড়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই। প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন মজুদ উত্তোলনযোগ্য ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজটিও খুব একটা গতি পাচ্ছে না। অবস্থায় আগামীতে চাহিদা সরবরাহের ব্যবধান ক্রমেই বাড়বে বলে আশঙ্কা জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। একই আশঙ্কা করছে খাতটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) সংস্থাটির এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ৫৫০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে গ্যাসের মোট চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভরতা বেড়ে ৮৫ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি এরই মধ্যে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে অর্থনীতিবিদদের। তারা বলছেন, দেশের মোট ব্যবহূত জ্বালানির প্রায় অর্ধেক প্রাকৃতিক গ্যাস। জ্বালানি পণ্যটির সংকট বেড়ে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে তা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকেই চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে।

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিইআরসিও। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে হারে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি পণ্যটির অভ্যন্তরীণ মজুদ ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। গত অর্থবছরেও (২০২০-২১) দেশে দৈনিক চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় সরবরাহের ঘাটতি ছিল ১৮৮ কোটি ঘনফুট। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৩৯০ কোটি ঘনফুট হবে। ২০৩০ সালে ঘাটতি আরো বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে। গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭ পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান সমন্বয়ের ভিত্তিতে তথ্য জানিয়েছে বিইআরসি।

গ্যাসের সরবরাহ সংকট মোকাবেলায় বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য পরিস্থিতি এরই মধ্যে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শিল্প খাতের সম্প্রসারণ ঘটছে অনেকটা গ্যাসের ওপর নির্ভর করে। জ্বালানি পণ্যটির টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত না করা গেলে সামনের দিনগুলোয় ধরনের বিড়ম্বনা আরো বড় হয়েও দেখা দিতে পারে। অবস্থায় দেশেই গ্যাসের অনুসন্ধান উত্তোলন কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি লাভজনক আমদানির পথও নিশ্চিত করা জরুরি।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক গড় চাহিদা ছিল ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় উত্তোলন আমদানীকৃত এলএনজি মিলিয়ে সরবরাহ হয়েছে ৩০১ কোটি ঘনফুট। সে হিসাবে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহের ঘাটতি ছিল প্রায় ১৩০ কোটি ঘনফুটে। আমদানীকৃত এলএনজির সরবরাহ বাদ দিলে শুধু স্থানীয় সরবরাহ বিবেচনায় নিয়ে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহে ঘাটতি ছিল প্রায় ১৮৮ কোটি ঘনফুট।

বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক . তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে গ্যাসের মজুদ ক্রমান্বয়ে ফুরিয়ে যাবে, এটি আগেই আমাদের প্রক্ষেপণ করা ছিল। কী পরিমাণ কমে যাবে সেটিরও উল্লেখ আছে। কিন্তু এর বিপরীতে সংকটটা কীভাবে সামাল দেব, তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গত এক বছরে পেট্রোবাংলার আওতাধীন কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদন কমেছে অন্তত ৫০ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসকূপগুলোর সক্ষমতা কমছে বহু আগ থেকে। এটি বাড়ানোর জন্য কম্প্রেসার বসানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ আমরা যথাসময়ে নিইনি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের মূল্যে অস্থিরতা চলছে। আগামীতে কী হবে সেটিও বলা মুশকিল। স্থায়ী সমাধানে যেতে হলে দেশীয় অনুসন্ধান-উত্তোলনের পাশাপাশি সরবরাহের সুষ্ঠু একটা চ্যানেল তৈরি করতে হবে।

জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে পর্যন্ত মোট ২৮ দশমিক ৩০ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রায় টিসিএফ (শূন্য দশমিক ৮৯ টিসিএফ) গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে মজুদ আছে দশমিক ৬০ টিসিএফ গ্যাস। এর বাইরে হাজার সরবরাহ সক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এফএসআরইউ রয়েছে। বর্তমানে তা দিয়ে দৈনিক ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে দুটি ইউনিট দিয়ে দশমিক ২১৬ টিসিএফ এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিনটি গ্যাস কোম্পানি এবং উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় দুটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে।

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাসাবাড়িতে প্রায়ই গ্যাস সংকট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান উত্তোলনের বাইরে গিয়ে আমদানিনির্ভরতার সহজ সমাধান দেশের জ্বালানি খাতকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন খোদ জ্বালানি খাতের কর্মকর্তারাই।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জ্বালানি বিভাগের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে অভিজ্ঞ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান না করার কারণ হিসেবে প্রায়ই বলা হয় তাদের আকৃষ্ট করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। এজন্য মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে প্রয়োজন। কিন্তু যে পরিমাণ তথ্য আমাদের কাছে আছে সেটুকু যদি আমরা উন্মুক্ত করে দিই, তা দিয়েই বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। মূলত বছরের পর বছর মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কারণ দেখিয়ে আমরা অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।

স্থলভাগের পাশাপাশি সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের জন্য ২০১৫ সালে দরপত্র আহ্বান করে সরকার। মূলত সাগরে জ্বালানি তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র কেনার আগে সাধারণত বিদেশী কোম্পানিগুলো দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপের তথ্য চায়। এজন্য দরপত্র আহ্বানের আগে একটি মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের প্রয়োজন হয়। এতে মূলত সম্ভাব্য মজুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই কূপ খননের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। নিয়ে ২০১৬ সালে আরো একবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। তবে এরপর আরো ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। যদিও উদ্যোগ আর এগোয়নি।

দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের পাশাপাশি গ্যাস আমদানি করতে পটুয়াখালীর পায়রায় ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এছাড়া এলএনজি আমদানিতে কয়েক মাস আগে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতাও (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। তবে কাতার ওমানের বাইরে কোনো দেশ এখন পর্যন্ত আমদানির দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেনি। এছাড়া গ্যাস আমদানিতে আরো নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। সেগুলো এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে।

ভবিষ্যতে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাসের চাহিদা পূরণে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এলএনজি আমদানিতে চুক্তি করেছি। দেশের গভীর সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ভারতীয় একটি কোম্পানি দুটি সমুদ্র ব্লকে কাজ করছে। তাদের তথ্য শিগগিরই আমরা পাব। এর বাইরে স্থলভাগে বাপেক্সের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গ্যাস আমদানির জন্য নতুন করে এফএসআরইউ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন