চলতি অর্থবছরের যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচি

কর্মপরিকল্পনাই চূড়ান্ত করতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ

মেসবাহুল হক

বিশ্বের মোট ২২টি দেশে যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) করা তালিকা অনুযায়ী, দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। সর্বশেষ ২০২০ সালে দেশে নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয় লাখ ৯২ হাজার ৯৪০ জন। সরকারি তথ্য বলছে, রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সে হিসেবে যক্ষ্মায় বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১০৭ জন মারা যায়। এমন বাস্তবতায় ২০১৭ সালে যক্ষ্মা এইডস নির্মূলে হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। তবে কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই বলে অভিযোগ করেছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই দুর্নীতির মাধ্যমে একক উৎস থেকে অতিরিক্ত দামে প্রয়োজনীয় ওষুধ সংগ্রহেরও অভিযোগ করা হয়েছে।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে টিবি-লেপ্রোসি অ্যান্ড এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের বাস্তবায়ন কমিটির সভায় এসব কথা উঠে আসে। সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, সেখানে কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা না থাকা অনিয়মের অভিযোগ করা হয়। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়নে কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দুর্নীতি এড়াতে একই উৎস থেকে ওষুধ সংগ্রহ না করা অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়।

বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির আওতায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে হাজার ৬৫৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে টিবি-লেপ্রোসি তথা যক্ষ্মা এইডস রোগ নির্মূলে কাজ করা হচ্ছে। শুরু থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে ৯১৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ২৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, তবে ব্যয় হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে ব্যয় বেশি হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

চলতি অর্থবছরের জন্য কর্মসূচির আওতায় বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট বৈঠক হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সেখানে কর্মপরিকল্পনায় ব্যাপক ভুল ধরা পড়ে। তাই ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে তিনদিনের মধ্যে সংশোধিত প্রস্তাব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এরপর দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সংশোধিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা পাঠায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক যে ওষুধ রোগীদের বিনামূল্যে দেয়া হয়, তার মজুদ রয়েছে ছয় মাসের পরিমাণ। ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ছয় মাস আগে থেকেই ওষুধ কেনার কার্যক্রম শুরু করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংশোধিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনাই প্রস্তুত হয়নি। কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতের পর তা অনুমোদনের জন্য আরো তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে। তাই এখনই যদি কাজ শুরু না করা হয়, তাহলে আগামীতে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক পর্যায়ের ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে। যক্ষ্মা রোগীর সুস্থ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা খুবই জরুরি। ফলে ওষুধের সরবরাহ ঠিক না থাকলে তার প্রভাব সরাসরি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ওপর পড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসবের জবাবে সভায় প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক জানান, চলতি অর্থবছরে ওষুধ ক্রয়সংক্রান্ত খাতে বরাদ্দ হওয়া অর্থের মধ্যে বাকি আছে মাত্র কোটি টাকা। কিন্তু খাতে আরো কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সেটির সংস্থান না হওয়ার কারণেই কর্মপরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। আর সে কারণেই এটি সময়ের মধ্যে জমা দেয়া যায়নি।

সভায় অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক পর্যায়ের ওষুধের সংকট দেখা দিলে কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব অর্থের সংস্থান করে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এসব ওষুধ সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুর্নীতি এড়াতে একক উৎস থেকে না কিনে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার থেকে ওষুধ কেনার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। আবার অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ম-নীতি অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানাতেও তাগাদা দেন।

তবে ওষুধ সংকটের বিষয়ে সভায় যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্ব্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিমুল ইসলাম। তার ধারণা, সভায় উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের যক্ষ্মা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে তিন লাখের কিছু কম রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়। গত বছর করোনার কারণে তা আড়াই লাখ হয়েছিল। রোগী নির্দিষ্টসংখ্যক বলে ওষুধের পরিমাণও নির্দিষ্ট। কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। তবে খুব বেশি পার্থক্য হবে না। দেশে এতদিন এভাবেই ওষুধ কেনা বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর হিসেবে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যক্ষ্মার ওষুধ কেনা চিকিৎসার জন্য জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কে বছর ধরা হয়। অনুযায়ীই সবকিছু হয়ে আসছে। বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন