দেশে ইস্পাত খাতের বিকাশে কাঁচামালের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান নিশ্চিত করে জাহজ ভাঙা ইয়ার্ড। বিশেষায়িত এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার উন্নয়নে সরকার কর্তৃক স্বতন্ত্র একটি মজুরি কাঠামোও প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি পদ্ধতিতে শ্রমিক নিয়োগের কৌশল অবলম্বনের ফলে এ কাঠামোর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা।
ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রথার কারণে শ্রমিকের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ইয়ার্ড মালিকরা। অন্যদিকে ঠিকাদাররাও নিয়মিত মজুরির চেয়ে কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ঠিকাদারি নিয়োগে বলা হয়েছে, কোনো ইয়ার্ড বা প্রতিষ্ঠান তার কাজের স্বার্থে ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারকে শ্রমিকের বেতন-ভাতাসহ অনান্য সুবিধা বহন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি শ্রমিকরা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত হবেন। এছাড়া কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নিবন্ধনসহ ১৮টি শর্ত মানলেই কেবল তাকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে।
শ্রমিকদের দাবি, নিয়মিত ইয়ার্ডগুলোয় স্ক্র্যাপ জাহাজ থাকে না; যার কারণে মালিকপক্ষ খরচ কমানোর জন্য শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করে না। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী এসব শ্রমিকের পরিচয়পত্রও দেয়া হয় না। অন্যদিকে ঠিকাদাররা নির্ধারিত মজুরির তুলনায় কম মজুরিতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক দ্বারা কাজ করান। এছাড়া শ্রমিকরা নির্ধারিত কাজের চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করানোর অভিযোগও তোলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি। শ্রমিকরা এসবের প্রতিবাদ করলে পরবর্তী সময়ে কাজে না নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়।
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ২০০৯ সালে প্রণীত স্বতন্ত্র মজুরি কাঠামো প্রণয়নের পর ২০১৮ সালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে আদেশ জারি করে। প্রজ্ঞাপনের তফসিল ‘ক’ অনুসারে দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে (গ্রেড-১) এ মজুরি মূল বেতনসহ মোট ৩৪ হাজার টাকা এবং দৈনিক মজুরি ১ হাজার ৩১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রেড-২-এ মূল বেতনসহ মোট ২৪ হাজার ২৫০ টাকা এবং দৈনিক ৯৩৫ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। আধা দক্ষ শ্রমিকদের (গ্রেড-৩) মূল বেতনসহ ২১ হাজার ২৫০ টাকা এবং দৈনিক ৮২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। অদক্ষ শ্রমিকদের (গ্রেড-৪) জন্য মূল বেতনসহ মোট ১৬ হাজার টাকা ও দৈনিক ৬১৫ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী প্রতিটি ইয়ার্ডের নিজস্ব শ্রমিক থাকার কথা থাকলেও জাহাজের মালিকরা এ নিয়মের বিকল্প পথে হাঁটছেন। শ্রমিকদের স্থায়ী না করার কারণে জাহাজ আমদানির পর তা চুক্তিভিত্তিক ঠিকাদারের হাতে তুলে দিচ্ছে মালিকপক্ষ।
ভুক্তভোগী শ্রমিকরা জানান, সরকার জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো পাস করলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। লোক দেখানোর জন্য মালিকপক্ষ গুটি কয়েক শ্রমিককে বেতন কাঠামোর মধ্যে নিয়োগ দিয়েছে। ঠিকাদাররা নিয়মিত মজুরি থেকে কম মজুরিতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। এসবের প্রতিবাদ করলে তাকে পরবর্তী সময়ে আর কাজে নেয়া হয় না।
শিপ ব্রেকিং ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি তপন দত্ত জানান, জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে মালিকদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটার কথা থাকলেও মালিকপক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাজ করায়, যার কারণে ঠিকাদাররা শ্রমিকদেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেন। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়ার্ডের কর্মপরিবেশে প্রভাব পড়ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে শ্রম আইনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলেও ঠিকাদার আইনানুযায়ী বেতন-ভাতা ও সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবেন।
মালিকপক্ষের দাবি, সব ইয়ার্ডে ঠিকাদারভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয় না। যাদের নিয়মিত অর্ডার নেই, তারা এ ঠিকাদারি প্রথায় শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। যেসব ইয়ার্ডে নিয়মিত জাহাজ ভাঙার কাজ চলমান, তারা স্থায়ী শ্রমিকদের দিয়েই কাজ সম্পন্ন করেন। তবে ঠিকাদারভিত্তিক কাজ হলেও শ্রমিকদের মধ্যে মজুরিবৈষম্য নেই বলে দাবি করে মালিকপক্ষ।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের সংগঠনের নিবন্ধিত ইয়ার্ডের সংখ্যা দেড় শতাধিক হলেও সারা বছর গড়ে ৩০ থেকে ৪০ ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটা হয়। তবে নিয়মিত স্ক্র্যাপ জাহাজ ইয়ার্ডগুলোয় না থাকার কারণে শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণ সম্ভব হয়নি। যে কারণে বেশকিছু ইয়ার্ডের মালিক ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। ফলে কর্মপরিবেশের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। তবে সরকারের আইন অনুযায়ী চাকরিবিধি ও বেতন-ভাতা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন বণিক বার্তাকে বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে সব ঠিকাদারকে প্রচলিত নিয়মনীতি মেনে লাইসেন্সের আওতায় আনা উচিত। এতে তাদের আরো বেশি দায়বদ্ধতা তৈরি হবে এবং আইন মানতে বাধ্য করা যাবে। তবে ঠিকাদাররা নিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি, সেফটি নিশ্চয়তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন কিনা, তা নিশ্চিত করবে মালিক কর্তৃপক্ষ। শিপ ইয়ার্ডে শ্রমকল্যাণ নিশ্চিতকরণে মালিক ও ঠিকাদার উভয়কেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাতের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।