আলোকপাত

কৃষিতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ও করণীয়

ড. মো. সাইদুর রহমান

বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। জিডিপিতে ধান-চালের অবদান উল্লেখযোগ্য। দেশে যে ধান উৎপাদন হয়, তার ৫৭ শতাংশই বোরো থেকে আসে, যার প্রায় ৬৯ শতাংশ উৎপাদন হয় ডিজেলচালিত অগভীর নলকূপের সেচের মাধ্যমে। ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করার কারণে ১৬ লাখ অগভীর নলকূপের ৭০ শতাংশের পরিচালনা খরচ ২৫ শতাংশের অধিক বৃদ্ধি পাবে। সেচযন্ত্রের ব্যবহার কেবল ধান চাষে সীমাবদ্ধ নয়। ফসলের জন্য জমি চাষ, মাছ চাষের জন্য পুকুরে পানি সরবরাহ এবং গবাদিপশুর খামারের কাজেও সেচযন্ত্রের ব্যবহার হয়। ধান অন্য কিছু ফসল কর্তনমাড়াই বাজারজাতে ডিজেলচালিত মেশিনের ব্যবহার রয়েছে। দেশে এখন প্রচুর পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়, যা মূলত সেচনির্ভর এবং সেগুলো সারা দেশে সরবরাহের জন্য পরিবহন কাজেও ডিজেলচালিত মেশিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া উপকূল হাওর এলাকায় এবং নদীবহুল দেশের অনেক জায়গায় নৌপথে ডিজেলচালিত নৌযানে দ্রব্যসামগ্রী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। ওইসব এলাকার মানুষজনও নৌযান ব্যবহার করে। উল্লিখিত সব কাজে বর্ধিত মূল্যের ডিজেল ব্যবহার হবে। বছর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদিত ধান অন্যান্য কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য বেড়ে যাবে এবং সাধারণ ভোক্তা সম্প্রদায় সামগ্রিকভাবে ক্ষতির শিকার হবে। কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কারণ তারা বাস বা পরিবহন মালিকদের মতো সংগঠিত না হওয়ায় তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের দাম যথেষ্ট পরিমাণ বাড়াতে পারবেন না। ফলে তাদের ভাগ্য ছেড়ে রাখতে হবে সরকারের নীতি, কৌশল সদিচ্ছার ওপর। সে কারণে সদাশয় সরকারকেই অসংগঠিত কৃষক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিয়ে তাদের বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।

মৌসুমভিত্তিক উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতের সময় স্বল্প হওয়ায় অনেক সময়ই দাম পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে উৎপাদকরা কম দাম পেয়ে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। উৎপাদন খরচ বেশি হবে ভেবে অনেকে সেই আশঙ্কায় উৎপাদন থেকে সরে দাঁড়ালে দ্রব্যের সরবরাহ কমে যাবে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। আর এগুলোই কৃষিপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ডিজেলের ২৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহন অন্যান্য বিষয়ের মিথস্ত্রিয়ায় উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এখানে মূলকথা হলো, পরিবহন মালিকদের বাস ভাড়া বৃদ্ধির মতো গাণিতিকভাবে বর্ধিত দাম কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই যদি হয়, তাহলে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষি কৃষক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। করোনা পরিস্থিতিতে যে কৃষকরা দেশের মানুষ অর্থনীতিকে চালু রাখল, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে তার কিছুটা হলেও সমন্বয় করতে হবে। কীভাবে সমন্বয় করা যাবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে।

কৃষি কৃষককে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে নিম্ন আয়ের মানুষদের। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী করোনায় কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের কথা ভাবতে হবে। সত্যিকার অর্থে সেটা করতে চাইলে প্রথমত ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার করা উচিত। তা না করলেও কৃষিতে ব্যবহূত ডিজেলের দাম অবশ্যই আগের মতো রাখতে হবে এবং তার জন্য কৌশল বের করার উদ্যোগ তথা গবেষণা আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করে হুট করে বাড়ানোয় কৃষিবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি মনে হচ্ছে।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের অর্থনৈতিক সংকট থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার ২৩টি প্যাকেজের আওতায় লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। উল্লিখিত নীতি-কৌশলের ধারাবাহিকতায় দেশে কৃষি উৎপাদন যাতে কোনো অবস্থাতেই কমে না যায়, তার জন্য কৃষি উৎপাদন কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হবে। চলতি অর্থবছর কৃষিতে ১০ হাজার ৯৯ কোটি টাকার ভর্তুকির প্রস্তাব প্রয়োজনে ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে। অন্য সব ক্ষেত্র বাদ দিলেও প্রধান খাদ্য ধান উৎপাদনে সেচের জন্য ব্যবহূত ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সমর্থনযোগ্য নয়। ধানের স্বল্পতা হলে বাজারে দামের গতি-প্রকৃতি কী হবে তা ২০০৭-০৮ সালের ধান-চালের বাজারদরের কথা মনে রাখা দরকার, যখন উচ্চমূল্য দিয়েও ধান-চাল আমদানি করা সম্ভব ছিল না। এমন পরিস্থিতি আবার হোক তা কোনো অবস্থাতেই দেশের মানুষ দেখতে চায় না। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সরকারের দায়িত্বশীল মহল পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেবে মর্মে যে আশ্বস্ত করেছে, তার জন্য কালবিলম্ব করা সঠিক হবে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণটি সামনে এনে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে কৃষক সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ানো কৌশলগত কারণেই সরকারের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রায় সব দ্রব্যের মূল্যস্তর বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে যাওয়া-আসার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে (যার কারণে তারা বাধ্য হয়ে বাস ভাড়া কমানোর আন্দোলনে নেমেছে), প্রতিদিন যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন ভাড়া নিয়ে কড়চা হচ্ছে এবং প্রতারিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। সবকিছু মিলিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবণ করে সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনা করলে দেশের কৃষি কৃষক তথা সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। তাছাড়া প্রচার মাধ্যম্যের তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম কমতেও শুরু করেছে। আর সে কারণেও ডিজেলের দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি রাখে।

 

. মো. সাইদুর রহমান: অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ এবং পরিচালক, কৃষি ব্যবসা উন্নয়ন শিক্ষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন