পরিবহন নেতাদের চাপে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না

আইন বাস্তবায়নে আর সময়ক্ষেপণ নয়

আন্দোলন, সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ কোনো কিছুতেই সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। করোনায় চলাচলে বিধিনিষেধের মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু থামেনি। সব নিয়মনীতি সুপারিশ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ পদক্ষেপই। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও এখনো এর বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি, এমনকি বাস্তবায়নের আগেই এর সংশোধন নিয়ে আলোচনা চলছে। এসবের পেছনে রয়েছে পরিবহন নেতাদের চাপ। বিশ্বের কোনো দেশে এমন নজির আছে বলে জানা যায় না। পরিবহন নেতাদের চাপে আইন প্রণয়ন করেও সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তার প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ সড়কে শৃঙ্খলার জন্য যেটি প্রয়োজন, সেটি বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কারো চাপের কাছে নতি স্বীকার কাম্য নয়।

সড়কে বিশৃঙ্খলতার জাতীয় সমস্যা সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না; যেন ধরেই নেয়া হয়েছে সড়ক-মহাসড়কে মানুষের মৃত্যু প্রতিনিয়তই ঘটবে, কারো কিছু করার নেই। কিন্তু করার অবশ্যই অনেক কিছু আছে। বাংলাদেশে কী কী কারণে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়এসবও বহুল আলোচিত বিষয়। অনেক গবেষণা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা অনুযায়ী দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। এক্ষেত্রে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। ২০১৮ সালে রাজধানীর কুর্মিটোলায় দুজন কলেজ শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। সরকারি সংস্থাগুলো সে সময় বলেছিল, শিশুদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সড়কপথে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নেয়া হয় নানা উদ্যোগ পরিকল্পনা; দেয়া হয় প্রতিশ্রুতিও। কিন্তু ওই পর্যন্তই, নতুন একটি সড়ক আইন করা হলেও মালিক-শ্রমিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে আইনটি আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক যে সড়কে নিরাপত্তা পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না বা আনছে না সরকার। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন আইন নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণেই খাতে শৃঙ্খলা আসছে না। নতুন সড়ক পরিবহন আইন করা হলেও মালিক-শ্রমিকের চাপের মুখে সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ করতে গেলেই বাধা আসে। ফলে রক্ষা হচ্ছে না যাত্রীস্বার্থ। অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সড়কে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতি বছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির শতাংশ। যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের নামটি সামনে চলে আসে। সিঙ্গাপুরে পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি গঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এক দশকের ব্যবধানে সংস্থাটি দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাহক সন্তুষ্টির দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে এক নম্বর। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, দুবাই, ইউরোপের সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে আদর্শ। প্রতিটি দেশই নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দেশগুলোয় সংশ্লিষ্ট আইনটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আইন বাস্তবায়নে তাদের প্রশাসন খুবই কঠোর, কোনো ছাড় দেয়া হয় না। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি নির্দেশকও বটে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশ বা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হওয়া বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এখনো বিশৃঙ্খলই রয়ে গেছে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো বিরোধ নয়। তারা পরিবহনসেবার মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা সচল রাখেন। তাই কেউই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে নয়। কোনো অন্যায্য আইন তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতীও নয় কেউ। কিন্তু মালিক-শ্রমিক নেতাদের স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে বলতে হবে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে কোন বিধানগুলো তাদের পেশাগত অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, জীবন বিপন্ন করবে। বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের দরকার নেই, সব পক্ষের অংশগ্রহণে আলোচনা হতে হবে। গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছে আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে দ্রুত। সাজা জরিমানার পরিমাণ যা- নির্ধারণ হোক না কেন, তা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ বাস্তবায়ন না হলে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থেকে কোনো লাভ হবে না। আইন মেনে পরিবহন মালিকরা সুষ্ঠুভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবেন, শ্রমিকরা নিরাপদে তাদের পেশাগত জীবন নির্বাহ করবেন, দুর্ঘটনা কমবেএটাই আমাদের প্রত্যাশা। পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এলে এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা গেলে দুর্ঘটনার পরিমাণ এমনিতেই কমে আসবে, যেমন কমে এসেছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায়।

পরিবহন মালিক শ্রমিকরা সবসময় আইনি শাস্তির বিষয়টি সামনে নিয়ে আন্দোলন করেন। অথচ গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে, চালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলে, সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে দুর্ঘটনা একেবারেই কমে আসবে, তখন শাস্তির বিষয়টি মামুলি হয়ে পড়বেএটা তারা বুঝতেই চান না। বিআরটিসি আন্তঃজেলা পর্যায়ে বাস পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কিছু মালিক-শ্রমিক সংগঠন বিরোধিতা করে, বাস কাউন্টার ভাংচুর করে। অথচ সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। বিআরটিএ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রস্তাবিত কোম্পানিভিত্তিক রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ পদ্ধতিটি সিন্ডিকেটের কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ এতে চাঁদাবাজি দুর্নীতির সুযোগ কমবে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) প্রায়ই নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থা বিষয়ে বৈঠক করে, এসব বৈঠকে কী উপকার হয় তাও দৃশ্যমান নয়। এতে সময়ক্ষেপণই শুধু হচ্ছে, কার্যকর সৃশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না। কারণে ঢাকায় গাড়ি চলাচলের গতি ক্রমেই কমছে, এখন তা হাঁটার গতির কাছাকাছি। এভাবে চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে মানুষকে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হবে, অনেকে এরই মধ্যে যাচ্ছেনও। উৎপাদনশীলতায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য কাম্য নয়।

মহাসড়কের পাশাপাশি শহরের ভেতরেও বিশৃঙ্খল অবস্থা। বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। সেখান থেকেই দুর্ঘটনা যানজট হয়। সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন করছে, চালকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আরো করণীয় আছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার আগে তার দক্ষতা যাচাইয়ের কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি নেই। গাড়ির তুলনায় চালক কম। রাস্তা আমাদের এলোমেলো, গাড়ির ফিটনেস প্রক্রিয়ায়ও গলদ রয়েছে, চালক তৈরির পদ্ধতি শুদ্ধ নয়, তাও বিআরটিএ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। অর্থাৎ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এসব জায়গায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াগুলো থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। বিশৃঙ্খল একটা সিস্টেম দিয়ে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয়। পথচারীবান্ধব ফুটপাত, বিজ্ঞানভিত্তিক কন্ট্রাকলেস ফিটনেস দেয়া, চালক তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া করা, রাস্তার পাশের হাটবাজারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

বলা হয়ে থাকে, কোনো দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য সুশৃঙ্খল পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শৃঙ্খল পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এছাড়া উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা কাজ এখনই শুরু করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কর্তৃপক্ষ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন