সাম্প্রতিক বিশ্ব

উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা বাড়াতে করণীয়

পিনেলোপি কোওজিয়ানো গোল্ডবার্গ

২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্রুকিংস পেপার্স অন ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি প্রকাশনার জন্য লিখিত এক নিবন্ধে ট্রিসটান রিড আমি সবার প্রত্যাশার বিপরীত একটি বিষয় দেখিয়েছিলাম। সেটি হলো, ধনী দেশগুলোর তুলনায় কভিড মহামারীতে মাথাপিছু মৃত্যু দরিদ্র দেশগুলোয় অনেক কম ছিল। পাঠকরা তাত্ক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন যে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কোথাও নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। এমনটা হলে সেটি অবশ্যই অব্যবস্থাপনা কিংবা দেশগুলোয় তথ্য ঘাটতির কারণে হবে। আমাদের অনুসন্ধান যদিও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল, তবে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল উন্মোচনমূলক। আর তা হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিসংখ্যানকে সন্দেহের চোখে দেখার একটা প্রবণতা বিরাজমান (এবং সেগুলো প্রায় ক্ষেত্রে গণহারে বাতিল করা হয়)

উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি কি ন্যায্য? জার্নাল অব ইকোনমিক পারস্পেক্টিভসের সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে হোয়াই ইজ গ্রোথ ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ সো হার্ড টু মেজার?- আমার সহলেখক আমি দেখেছি যে এটি ন্যায্য নয়। তথ্য কারসাজির কিছু বহুল প্রচারিত ঘটনা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ গড়পড়তা উন্নত দেশগুলোর মতোই নির্ভরযোগ্য।  

সত্যি বলতে কি, একটি দেশের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ বিচারের জন্য কোনো একক, সুসংজ্ঞায়িত মানদণ্ড নেই। তবে অর্থনৈতিক সাহিত্যে গতানুগতিক অ্যাপ্রোচ হলো যে বিভিন্ন তথ্য উৎস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাক্কলনগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে বের করা। পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে আমরা সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস (এসএনএ), খানা জরিপ তথ্য নতুনভাবে সহজলভ্য স্যাটেলাইট তথ্য (প্রধানত রাত্রিকালীন আলো, আবহাওয়া, ফসল-ফলাদি উৎপাদনবিষয়ক তথ্য) তিনটি স্বতন্ত্র উৎসভিত্তিক প্রাক্কলনগুলো তুলনা করেছি। 

ধরনের তুলনায় দেখা গেছে তিনটি উৎসের তথ্য ব্যবহার করে প্রাপ্ত গড় প্রবৃদ্ধি হারগুলোর মধ্যে পার্থক্য বেশ ছোট, সেটি সাধারণত দশমিক শতাংশীয় পয়েন্টের কাছাকাছি কিংবা তারও কম। তবে মাত্রার ব্যবধান উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় বেশ বড় বিবেচিত হলেও (যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার - শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে) দ্রুত বর্ধনশীল অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তা বেশ পরিমিতই বলা যায়। প্রায় দশমিক শতাংশীয় পয়েন্টের এরর মার্জিন মনে হয় এসব প্রাক্কলন ঘিরে অনিশ্চয়তার দিক থেকে খুব বড় বা গভীর কিছু নয়। 

তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে পরিচালিত নতুন ডাটাবেজে প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর এসএনএ তথ্য রাজনৈতিক কারণে পদ্ধতিগতভাবে কারসাজি করা হয়। মজার বিষয় হলো, মধ্যম আয়ের দেশগুলো মনে হয় বরং এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাজনক। সেখানে পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা সূক্ষ্মতার কিছু প্রান্ত সীমার ওপর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত কারসাজির প্রবণতা অধিক দেখা যায়। একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে উন্নয়নশীল দেশ বিষয়ে এসব অনুসন্ধান আশাবাদের একটা কারণ। কেননা দেশগুলোয় তৈরীকৃত পরিসংখ্যানগুলো প্রকৃতপক্ষে অর্থবহ এবং সেগুলো গয়রহভাবে বাদ দেয়ার বিষয়টি হবে তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভুলভাবে জানার ফল। 

যা- হোক না কেন, দরিদ্র দেশগুলো স্পষ্টতই বৃহত্তর পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা থেকে সুফল পেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের শান্তা দেবরাজন ২০১৩ সালের এক প্রভাবশালী নিবন্ধে যেমনটা বলেছিলেন, নিম্ন আয়ের দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো একটি পরিসংখ্যানগত ট্র্যাজেডিতে ভোগে। তথ্য আহরণ, ব্যবস্থাপনা এবং ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সম্পদের ঘাটতি এবং সংশ্লিষ্ট এজেন্সি অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অনেক নিম্ন আয়ের দেশে নীতিনির্ধারকরা পুরনো তথ্য সেকেলে পদ্ধতি ব্যবহারে বাধ্য হন।  

প্রকৃতপক্ষে অনির্ভরযোগ্য প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলনের বহুল প্রচারিত কিছু ঘটনা বরং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত তথ্য কারসাজির চেয়ে সেকেলে পদ্ধতি ব্যবহার থেকে সৃষ্ট। এমনকি এসব ঘটনা সত্ত্বেও বিপুল প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো আপেক্ষিকভাবে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান তৈরিতে ঈর্ষণীয় কাজ করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো কীভাবে তাদের পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা বাড়াতে পারে? এটি করার চেয়ে বলাটা সহজ। দ্য জার্নাল অব ইকোনমিক পারস্পেক্টিভে প্রকাশিত আমাদের গবেষণাপত্রে আমার সহলেখক আমি যেমনটা ব্যাখ্যা করেছি, জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা জোগানোর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাগুলোয় জাতীয় পরিসংখ্যানবিদদের দক্ষতা জ্ঞান বৃদ্ধি কিংবা ডাটা সিস্টেমের উন্নয়নের পরিবর্তে একবারের তথ্য সংগ্রহের কর্মকাণ্ডে প্রায়ই বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। একটি সুস্পষ্ট চূড়ান্ত তারিখসহ তথ্য সংগ্রহ একটি তুলনামূলকভাবে সুসংজ্ঞায়িত কাজ, যা সাধারণত একটি সম্পাদন প্রতিবেদনসহ আবৃত থাকে। পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা উন্নয়ন করতে বিনিয়োগগুলো তদারক করা অধিকতর কঠিন। এক্ষেত্রে সফল হওয়ার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত, সময়সাপেক্ষ এবং সেখানে প্রায় ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আউটকাম ডেলিভারির ঘাটতি থাকে। 

ধরনের বিনিয়োগের উচ্চব্যয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত অনিশ্চয়তার বাস্তবতায় সেগুলো মনে হয় না দুঃসময়ে অব্যাহত রাখা যাবে, যখন সরকারগুলো এরই মধ্যে কভিড সংকটের কারণে আর্থিক চাপে রয়েছে।

সৌভাগ্যক্রমে, আরো একটি টেকসই অ্যাপ্রোচ আছে। সেটি হলো, প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো এবং সম্পদ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে গতানুগতিক উৎসের সঙ্গে নতুন তথ্য উৎস ব্যবহার করা। নতুন প্রকাশ্যে সহজলভ্য তথ্যগুলো (ওয়েব, গুগল সার্চ, ডিজিটাল লেনদেন, সেলফোন মেটাডাটা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার এবং স্যাটেলাইট ডাটা প্রভৃতি) নিম্নব্যয়ে গবেষকদের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চলকগুলো নির্ণয়ে সাহায্য করেছে। 

ধরনের তথ্যের উৎসগুলো, বিশেষ করে মহামারীর সময়ে অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র্য, মূল্যস্ফীতি, ব্যবসার সম্ভাবনা, জনকল্যাণ প্রভৃতি বিষয়ে রিয়েল টাইম অতি প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রাপ্তিতে বেশ উপকারী প্রমাণ হয়েছে। বড় বিষয় হলো, গতানুগতিক পদ্ধতিগুলোর (যেমন মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ) চেয়ে এসব তথ্য যেহেতু  দ্রুত অনেক কম খরচে পাওয়া যায়, সেহেতু সম্পদ ঘাটতির উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটা একটা আশাবাদের বড় উৎস হতে পারে।

তবে এসব নতুন তথ্য অবশ্য সীমাবদ্ধতা ছাড়া নয়। এখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। গতানুগতিক তথ্যের উৎসগুলো সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ তথ্যের কাভারেজ নিশ্চিতে সমর্থ হলেও নতুন তথ্য নির্বাচন সমস্যায় (সিলেকশন প্রবলেম) ভুগতে পারে। যদিও সেগুলো ব্যাপক নমুনা তৈরি করতে পারে, তবে সেগুলো কোনো দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার জন্য খুব কমই প্রতিনিধিত্বমূলক হতে পারে। 

মহামারীর মধ্যে ভালো তথ্যের আশা করা কিছুটা হাস্যকর মনে হতে পারে, যখন নিম্ন আয়ের অনেক দেশই এখনো তাদের জনগণের জন্য জীবনরক্ষাকারী টিকা নিশ্চিতে সমর্থ হয়নি। তার ওপর মহামারীর অন্যতম বড় ঝুঁকি রয়ে গেছে যে এটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন এজেন্ডাগুলো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনোযোগের বাইরে নিয়ে যাওয়া কিংবা স্থগিত করার কারণ হবে। ঠিক যেমন নারীর ক্ষমতায়ন মানবসম্পদে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাড়তি পদক্ষেপ নিতে নীতিনির্ধারকরা সচেষ্ট, তেমনি তাদের বৃহত্তর পরিসংখ্যানগত সক্ষমতাও যুগপত্ভাবে বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, সেসব বিষয়ে আমরা উন্নতি ঘটাতে পারব না; যা আমরা পরিমাপ করতে পারি না। কাজেই এদিকটায় দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে বৈকি।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

পিনেলোপি কোওজিয়ানো গোল্ডবার্গ: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ; ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক; আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর এডিটর-ইন-চিফ

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন