নগর পরিকল্পনা

ঢাকা অনুসরণ করতে পারে মেলবোর্ন ও ডুসেলডর্ফের দৃষ্টান্ত

রুহিনা ফেরদৌস

একটি টেকসই উন্নত নগরের সত্যিকারের দৃশ্য কী? চারপাশজুড়ে বিশালাকৃতির ইমারত, সড়কভর্তি সারি সারি ব্যক্তিগত গাড়ি, যানজটে বসে থাকা ক্লান্ত মানুষ? নাকি অনেকটা সবুজ, প্রশস্ত ফুটপাত, প্রয়োজনীয় গণপরিসরযেখানে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে নগরের বাসিন্দারা, শিশুরা খেলছে, কেউ কেউ আবার ল্যাপটপে জরুরি কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে।

পশ্চিম জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরটি ১৯৯০ সালের দিকে দেখতে ছিল অনেকটা আমাদের রাজধানী ঢাকার মতো। সড়কজুড়ে সারি সারি গাড়ি। একপাশে ফ্লাইওভার। পাশে রাইন নদী। নদীপাড়ে অল্প খানিকটা জায়গা থাকলেও সেখানে জনমানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে ২০১৯ সালে এই একই জায়গায় ঠিক ভিন্ন চিত্র দেখা যায়।

রাইন নদীর তীরজুড়ে প্রশস্ত জায়গা। রাস্তার ওপর ফ্লাইওভারটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি সবুজ গাছ। আর নদীর পাড়টি জমে উঠেছে নগরের মানুষদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোর এম্বারকাডেরো উপকূলের কথাই যদি ধরা হয়। ১৯৯২ থেকে ২০০৩মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে প্রশস্ত ফুটপাতসমেত চমত্কার একটি গণপরিসরে রূপ দেয়া হয়েছে জায়গাটিকে।

১৯৯০ সালে পশ্চিম জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহর।

   ২০১৯ সালের ডুসেলডর্ফ। রাইন নদীর তীরজুড়ে প্রশস্ত জায়গা। রাস্তার ওপর ফ্লাইওভারটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

পর্যায়ে প্রশ্ন তৈরি হয়, তাহলে জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহর কিংবা সানফ্রান্সিসকোর এম্বারকাডেরো কি উন্নত হয়েছে নাকি অনুন্নত?

১৯৮০-এর দশকের মেলবোর্ন; অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যানজট আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘিরে শহর ছাড়তে শুরু করেছে এর বাসিন্দারা। তাদের শহরত্যাগের কারণে মেলবোর্ন রীতিমতো ভুতুড়ে নগরে পরিণত। অফিসগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। বিপর্যয় নেমে এসেছে আবাসন খাতে। মেলবোর্ন রীতিমতো ধুঁকছে।

১৯৮৩ সালে শহরের পৌর প্রশাসনে কাজ করতে আসেন রব অ্যাডামস। তার জন্ম জিম্বাবুয়েতে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়েছেন স্থাপত্য নিয়ে। মেলবোর্নকে পতিত দশা থেকে রক্ষা করতে অ্যাডামস অনেক উদ্যোগ নেন। সে সময়ে মেলবোর্নের মূল বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা হতো সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোর জন্য যা স্বাভাবিক। কিন্তু মেলবোর্নের বাস্তবতায় অ্যাডামসের কাছে তা স্বাভাবিক মনে হয়নি। অ্যাডামস ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নীতি গ্রহণ করেন।

তাছাড়া আধুনিক নগর পরিকল্পনায় ব্যাণিজ্যিক অফিস আর এলাকাগুলোকে বিচ্ছিন্ন রাখার যে নিয়ম, তা অ্যাডামসের পছন্দ নয়। অ্যাডামসের মনে হয়েছিল, এভাবে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে মেলবোর্ন তার সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে সমর্থ হচ্ছে না। তিনি তার নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরটির শূন্য অফিস ভবনগুলোকে নতুন আবাসিক স্থানে পরিণত করেন। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর তা হলো, বিভিন্ন স্থানে গণপরিসর তৈরি। উদ্দেশ্য, নিরুদ্যম শহরের গতি ফেরানো।

ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে ফেডারেশন স্কয়ার নির্মাণ করা হয়। ফেডারেশন স্কয়ার হচ্ছে একটি পুরনো রেলস্টেশনের জায়গায় নির্মিত প্রশস্ত গণপরিসর। আগে যেখানে জায়গাটিতে জনমানুষের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেত না, এখন সেখানে সবসময়ই লোকসমাগম। ফেডারেশন স্কয়ারের পেছনের সরু আর অন্ধকার গলিগুলোও আজ আধুনিক ক্লাব আর রেস্তোরাঁয় ছেয়ে গেছে। কারণ সবাই জানে, এখানে এখন আর লোকের অভাব হবে না।

 ফেডারেশন স্কয়ার 

ষাটের দশকের শেষ দিকে অ্যাডামস যখন কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শ্রেণীকক্ষসহ বিভিন্ন অনুষদ ভবন সম্প্রসারণের উদ্যোগ হাতে নেয়। হরহামেশা যেমনটা হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেমন গড়পড়তা ধারণা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিল। যেমন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নতুন কয়েকটি ভবন নির্মাণ আর বিদ্যমান ভবনগুলোর পরিসর বৃদ্ধির পরিকল্পনা।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য পুরনো স্থাপনাগুলো ধরে রাখতে কিংবা পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত হওয়ায় স্রেফ ভূপ্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে কর্তৃপক্ষ শেষমেশ অভূর্তপূর্ব একটি সমাধান নিয়ে আসে। আর তা হচ্ছে পরিসর বৃদ্ধির পরিবর্তে সময় বৃদ্ধি। নতুন কোনো স্থাপনা ভবন ভাংচুরের মধ্যে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সন্ধ্যাকালীন ক্লাস সংযোজন করে শিখন-পঠনের সময় বাড়িয়ে নেয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন না করেই তারা তাদের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি আর শ্রেণীকক্ষের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ওই প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষ করার কারণে অ্যাডামস শহুরে পরিসর পরিবেশে নতুন করে পুরনো মূল্যবোধের প্রচলন ঘটাতে আগ্রহী ছিলেন। তাই মেলবোর্নের সাফল্যগাথাটিও মূলত রব অ্যাডামসের চমত্কার একটি নগর পরিকল্পনার অংশ।

 

    রব অ্যাডামস : অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের বিপরীতে টেকসই নগর তৈরির সাশ্রয়ী দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এ স্থপতি

জার্মানির ডুসেলডর্ফ, সানফ্রান্সিসকোর এম্বারকাডেরো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের উদ্যোগগুলো সহজে চোখে পড়ে না। আমরা কিছুদিন পরপর উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার নাম। অথচ টেকসই নগর পরিকল্পনার চমত্কার একটি উদাহরণ হতে পারে মেলবোর্ন।

বর্তমান নগর পরিকল্পনার মূল আলোচনায় পরিণত হয়েছে মেলবোর্নের রূপান্তর। অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, যা আমাদের স্বাভবিক জীবন ব্যাহত করে, তার বিপরীতে অ্যাডামস যেন টেকসই নগর তৈরির সাশ্রয়ী দিকনির্দেশনা দেখান। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ের কারণে এখন আমাদের আর সম্পদ নষ্ট করার সময় নেই। তাই আমাদের শহর আর সেখানের জনসংখ্যার ঘনত্ব নিয়ে ভাবতে হবে যে কীভাবে টেকসই উপায়ে আমরা এর ব্যবহার বাড়াতে পারি।

গাড়ি চলাচলের জায়গার বদলে ৮০ হেক্টরের মতো ফুটপাত প্রশস্ত করা কিংবা নতুন উন্মুক্ত জায়গা তৈরি করার নানা ধরনের সামাজিক উপকারিতা আছে। আর তা হচ্ছে, এর ফলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি ঘটে, সৃজনশীলতার বিকাশ হয় তরুণদের মধ্যে আর শিশু বৃদ্ধরা সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায়। স্থপতি অ্যাডামসের মতে, শহরের প্রতি বর্গমিটার জায়গা যদি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়, তখন তা মানুষের টেকসই যোগাযোগ স্থাপনের একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়।

তিনি মনে করেন, একটি নগর তার প্রয়োজন অনুসারে ৯টা-৫টার গত্বাঁধা নিয়মের পরিবর্তে সময়গুলো ভাগ করে নিতে পারে। এতে সকালের স্কুলগামী শিশু আর অফিসের দিকে ছোটা লোকদের ভিড় মিলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হবে না। তবে ব্যস্ততম সময়গুলো পুনর্নির্ধারণ করতে আমাদের বিভিন্ন স্থানে পাবলিক ডিজিটাল প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যা জনসাধারণের শোভন আচরণগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। পুরস্কার হিসেবে টোলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের স্কিম করে ছাড় প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি অফিসে না এসে বাড়িতে বসে কাজ করার ব্যবস্থা রাখা, যেমনটা আমরা কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে দেখেছি। ধরনের কার্যক্রম সত্যিকার অর্থেই একটি নগরকে পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম। যেমন কিছু কর্মী সকাল ৯টায় অফিসে আসতে পারেন, বাকিরা সকালের মিটিংয়ে ভিডিওকলের মাধ্যমে যুক্ত হবেন এবং তারা অফিসে পৌঁছবেন বেলা ১১টা নাগাদ। ফলে ব্যস্ত সময়গুলোয় ভিড় এড়ানো সম্ভব হবে। 

মেলবোর্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে নগর পরিকল্পনাকে আমরা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি, বিশেষ করে ব্যস্ত সময়গুলোয় ভিড়মুক্ত রাখতে পারি। মোটের ওপর আমরা যদি প্রতিদিন সবাই একটা নির্দিষ্ট সময় একসঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে যে যার গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যানজটের সৃষ্টি হবে। নগর ব্যবস্থাপকরা যদি যানজটের উৎসটি বিবেচনা করেন, তবে তারা শহরগুলোর সবচেয়ে কদাকার বৈশিষ্ট্য (পড়ুন যানজটকে) নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবেন। আমরা যদি ভিড় এড়ানোর ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের দিকে অগ্রসর হতে পারি, তাতে আমাদের শহরগুলো একদিকে যেমন আরো বেশি টেকসই হবে, তেমনি জট পাকানো মনে হবে না।

বর্তমানে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে থাকে মেলবোর্ন। এখানে সমৃদ্ধ স্ট্রিট কালচার নান্দনিক বিভিন্ন শিল্পকর্ম যেমন রয়েছে, তেমনি আছে প্রয়োজনীয় গণপরিসর। পুরনো জীর্ণ স্থাপনাগুলো নতুন করে গণপরিসরে রূপান্তর করা হয়েছে। ফেডারেশন স্কয়ার কিংবা ইয়াররা নদীতীরের সাউথ ওয়ার্ফের বিভিন্ন এলাকার কথাই যদি বলা হয়, এখানে এখন সমসময়ই লোকসমাগম থাকে। অ্যাডামসের ২৪ ঘণ্টা খোলা নীতির কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে মেলবোর্নের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চলে (সিবিসি) চাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করে। কারণ মেলবোর্ন কখনো ঘুমায় না বা এর কার্যক্রম কখনো বন্ধ হয় না। প্রতিটি সপ্তাহ, প্রতিদিন আর প্রতি ঘণ্টাকে কাজে লাগানো হয়।

মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ার খুব আলাদা বা স্বতন্ত্র কোনো শহর নয়। ১০ হাজার স্কয়ার কিলোমিটারের নগরে থেকে আপনি সমতল ভূমিতে পিঠ এলিয়ে বিশ্রাম নিয়ে কিংবা নদীতে খানিক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। লন্ডনের চেয়ে ছয় গুণ আর নিউইয়র্কের চেয়ে ১২ গুণ বড় মেলবোর্নের কেন্দ্রস্থলজুড়ে বাকি শহরগুলোর মতো উঁচু উঁচু ভবন দাঁড়িয়ে থাকলেও চারপাশটা বিস্তীর্ণ শহরতলির আবহ দিয়ে ঘেরা। তাই সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া নয়, ঢাকার জন্য মেলবোর্ন দৃষ্টান্ত অনুসরণই বেশি সাশ্রয়ী।

 রুহিনা ফেরদৌস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন