এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘে অনুমোদন

উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হোক

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। সিডিপি একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ২০২১-২৬ সাল পর্যন্ত প্রস্তুতিকালীন সময় প্রদানের সুপারিশ করে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক সামাজিক পরিষদ এরই মধ্যে সুপারিশ অনুমোদন করেছে। আশা করা হচ্ছে, প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশের উত্তরণ যথাসময়ে কার্যকর হবে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ হিসেবে জাতিসংঘ নির্ধারিত উত্তরণের তিনটি মানদণ্ড পূরণের মাধ্যমে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুপারিশ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বড় অর্জন। তবে এর চ্যালেঞ্জও আছে। অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য আগামী কয়েক বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক আঞ্চলিক পরিবেশ-পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল নয়। বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী বছরগুলোতে অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যেতে হবে। তাছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন করে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বাংলাদেশের সামনে, যা মোকাবেলার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।

এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের বিশ্বের বুকে আরো মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ উন্মোচিত হলো। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তির আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ব দরবারে বিভিন্ন দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্ত হবে। এছাড়া ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পাওয়াও সুবিধাজনক হবে। যেসব দেশ এখন পর্যন্ত স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পান। তাই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধি পাবে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক শিল্পায়ন হবে বলে আশা করা যায়। অনেক দেশের সঙ্গে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারও উন্মুক্ত হবে।

অন্যদিকে জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রফতানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতিও থাকবে না, যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো বেশি সময় পাবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্ববাজারে বিপণন বিনিয়োগ আকর্ষণ এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে মূল সমস্যা হলো, একমাত্র ভুটান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। আমাদের উন্নত দেশগুলো ছাড়াও ভারত চীনের মতো বড় বড় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করতে হবে। দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তিতে যেসব বাড়তি সুযোগ রয়েছে সেগুলোও হারাতে হবে। ফলে বৈদেশিক অনুদান কম সুদের ঋণ কমে আসবে। এতে বৈদেশিক ঋণের ব্যয় বেড়ে যাবে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক কমে গেছে। তাই বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে বাংলাদেশের শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ না পাওয়ায় বৈদেশিক অনুদাননির্ভর এনজিওগুলোর অর্থ সংকট দেখা দিতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশী ফেলোশিপ, স্কলারশিপ, প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক জার্নালে নিবন্ধ ছাপানোর প্রকাশনা ফি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়সহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশীরা প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের যে অব্যাহতি রয়েছে, তা পাওয়া যাবে না। এছাড়া ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে প্রাপ্ত শুল্ক সুবিধাও হারাতে হবে, যা দেশের ওষুধ রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য গঠিত ফান্ড থেকেও বাংলাদেশ কোনো সহায়তা পাবে না। এসব বিষয় আমলে নিয়ে দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।

বাংলাদেশ এখন আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে, যাতে ভবিষ্যতে সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে দ্রুত উন্নত বিশ্বে পরিণত করা যায়। প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করে সেগুলো সমাধানের পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়নে কাজ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরর ফলে -সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ বর্তমানে আত্মনির্ভরশীল। পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার কাজ করে চলেছে। এছাড়া ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ ধাপ উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা দেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। যদি জিএসপি প্লাস পাওয়া কঠিন হয় বা পাওয়া না যায়, তাহলে এর বিকল্প কিছু পেতে হবে। কিন্তু প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে ধরনের সুরক্ষাগত প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তা আমাদের নেই। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির এই প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ করতে হবে। পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করার মাধ্যমে আমদানি-রফতানিতে ব্যয় কমানো প্রয়োজন। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি সক্ষমতা আরো বাড়াতে এবং মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। ব্যাংকিংসহ পুরো আর্থিক খাতে সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কমাতে হবে খেলাপি ঋণ।

উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে দক্ষ মানবসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তরুণ সমাজকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের উদ্যোগের কারণেই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রচলিত পণ্য রফতানিতে সাময়িক সমস্যা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহে বড় ধরনের ক্ষতির প্রভাব সামাল দেয়া যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, তাই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব।

এলডিসি থেকে বের হওয়ার অনেক সুবিধাও রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের কদর বাড়বে উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা মর্যাদা পাব। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি উদীয়মান এবং এখানে বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছেএমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে মানে অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধিতে বিনিয়োগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন