নিটারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান

৩৬৫ দিনের বছরে পরীক্ষা নিয়েছেন ৪৪২ দিন!

সাইফ সুজন

৩৬৫ দিনের বছরে ৪৪২ দিন শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়েছেন বলে দাবি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফলিত রসায়ন কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক . মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চের (নিটার) অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকাকালে এসব পরীক্ষা নিয়েছেন বলে ঢাবি কর্তৃপক্ষের কাছে বিলও জমা দিয়েছেন তিনি। যদিও নিটারের শিক্ষকরা বলছেন, আদতে একদিনও পরীক্ষাস্থলে যাননি তিনি। এমন আরো বেশকিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঢাবি উপাচার্যের কাছে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন নিটারের শিক্ষকরা।

২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত নিটারের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক . মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় নিটারে একাডেমিক অ্যাডভাইজার নামের একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছাড়ার আগেই তাকে পদে নিয়োগের আগাম সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে অধ্যক্ষ পদে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর নিটারের একাডেমিক অ্যাডভাইজার হিসেবে (খণ্ডকালীন) যোগ দেন মিজানুর রহমান। যদিও সম্প্রতি শিক্ষার্থী আন্দোলনের মুখে পদও ছাড়তে হয়েছে তাকে।

অধ্যক্ষ একাডেমিক অ্যাডভাইজার পদে থাকাকালে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিভিন্ন ধরনের আর্থিক, প্রশাসনিক নৈতিক অনিয়ম করেছেন জানিয়ে ঢাবি উপাচার্যের কাছে অভিযোগপত্র দিয়েছেন ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা। সেখানে বলা হয়, অধ্যক্ষ পদে যোগদানের পর অসংখ্য আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ না নিয়েই নিজের নামে লাখ লাখ টাকা বিল করে তুলে নেন তিনি। অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণেও মিজানুর রহমানের অবাধে অবৈধভাবে অর্থ গ্রহণের প্রমাণ মেলে। দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ৪৪২ দিন পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। শিক্ষকদের অভিযোগ, মিজানুর রহমান একদিনও ব্যবহারিক পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু বিল ঠিকই তুলে নিয়েছেন। তিনি যে বিল জমা দিয়েছেন সে অনুযায়ী এক শিক্ষাবর্ষের বেশি সময় ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

নিজে অবৈধভাবে বিল নেয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের সম্মানী ভাতা থেকেও কমিশন গ্রহণের অভিযোগ উঠছে মিজানুরের বিরুদ্ধে। বিটিএমএ-এসইআইপি শীর্ষক একটি প্রকল্পে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিটারের ১৫ জন শিক্ষক। প্রশিক্ষণ প্রদান বাবদ প্রাপ্ত সম্মানীর অর্থ থেকে প্রত্যেক প্রশিক্ষককেই নির্দিষ্ট হারে কমিশন দিতে হয়েছে মিজানুর রহমানকে। কমিশন বাবদ দেয়া লাখ ১৯ হাজার টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য বিটিএমএ-এসইআইপি প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারীর কাছে আবেদন করেছেন নিটারের সেই ১৫ জন শিক্ষক।

নিজেকে ভুক্তভোগী দাবি করে নিটারের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে আমি মোবাইল অ্যাকাউন্টে সম্মানীর অর্থ বুঝে পাই। তবে দুঃখের বিষয় হলো প্রাপ্ত অর্থ থেকে অধ্যাপক মিজানুর রহমান ৪৫ হাজার টাকা তাকে দিতে বাধ্য করেন। আমি নিজে তার হাতে টাকা দিয়ে আসি, উনি তা গ্রহণ করেন। যা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি আমার কর্মক্ষেত্রের উদ্যমকেও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ওই অবস্থায় আমাদের কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। কারণ চোখের সামনেই তার আক্রোশের শিকার হয়ে চাকরি হারাতে দেখেছি। এদিকে প্রাপ্য বেতনের পূর্ণাঙ্গ অর্থ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে না নিয়ে ৬০ শতাংশ নগদে নিতেন অধ্যাপক মিজানুর। নিটারের এক অফিস নোটে দেখা যায়, অধ্যক্ষের মূল বেতনের লাখ টাকার মধ্যে লাখ টাকা তার ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হবে। অবশিষ্ট মূল বেতন আনুষঙ্গিক ভাতাদি বাবদ লাখ হাজার ৪৯০ টাকা নগদে পরিশোধ করা হবে। আয়কর ফাঁকি দিতে প্রক্রিয়ায় বেতন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে লিয়েনে পাঁচ বছর নিটারে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করলেও একাডেমিক অ্যাডভাইজার পদে যোগদানের ক্ষেত্রে ঢাবি কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদনই নেননি শিক্ষক। এমনকি আয়ের কোনো অংশও বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দেননি তিনি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী, বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হলে অবশ্যই আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। পাশাপাশি আয়ের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দিতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেয়া অভিযোগপত্রের সঙ্গে দুজন নারী সহকর্মী অধ্যাপক মিজানুর কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে তাদের লিখিত বক্তব্যও সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন বলেন, বিভিন্ন কাজের অজুহাতে নিজের কক্ষে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দিতেন মিজানুর রহমান। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ছুটি না দেয়াসহ বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত জুনে মিজানুর রহমানের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন বলেও অভিযোগ করেন ওই নারী শিক্ষক। গবেষণার নামে অযথা নিজের কক্ষে ডেকে বসিয়ে রাখার অভিযোগ করেছেন আরেক নারী সহকর্মী।

এছাড়া দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদান সংগ্রহ করে সে অর্থ থেকে শিক্ষাবৃত্তি না দেয়া, ভর্তি বাতিল করলে অতিরিক্ত দুই বছরের টিউশন ফি নেয়া, অধ্যক্ষ পদ ছাড়ার পরও এখন পর্যন্ত গাড়ি ব্যবহার, ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে বেতন-ভাতা কেটে নেয়া ছুটিতে পাঠানোসহ কয়েক ডজন অভিযোগ জমা দিয়েছেন নিটারের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক পদে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিলের বিষয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই। যেহেতু আমি সার্বক্ষণিক নিটারে অবস্থান করতাম, তাই শিক্ষকরাই সম্মান করে বিলে আমার নাম সংযুক্ত করতেন। বেতনের একটি অংশ আমি ক্যাশে নিতাম এটা সত্য। আর করোনার কারণে একাডেমিক অ্যাডভাইজার পদে যোগদানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়নি। তবে অন্যান্য অভিযোগের বেশির ভাগই মিথ্যা। যদি কোনো অভিযোগ থাকত, তাহলে তাদের উচিত ছিল আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সেটি প্রকাশ করা। এখন দায়িত্ব ছেড়ে আসার পর আমার সম্মানহানির ষড়যন্ত্র চলছে।

অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, সোমবার নিটারের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। আমি তাদের সেখানকার গভর্নিং বডির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছি। অধিভুক্ত হওয়ার কারণে কিছু বিষয় আমরা দেখভাল করি। বাকি সব বিষয় গভর্নিং বডি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তদারক করে। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় থাকলে সেটি আমরা খতিয়ে দেখব।

নিটারে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমি দেশের বাইরে ছিলাম। আসার পর নিটারের কিছু সমস্যার কথা শুনেছি। তবে লিখিত কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। নিয়ে আগামীকাল (আজ) একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন