আলোকপাত

উন্নয়ন অর্থনীতি বইয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

দেড় দশক আগের কথা। সবে ডক্টরাল কোর্সে ভর্তি হয়েছি। দ্বিতীয় সাক্ষাতেই সুপারভাইজার কিছু বই দিলেন পড়ার জন্য। বইগুলো সম্পর্কে আমার পূর্বজ্ঞান একেবারে শূন্য। এর মধ্যে ছিল নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থের একটি বই, ইনস্টিটিউশনস, ইনস্টিটিউশনাল চেঞ্জ অ্যান্ড ইকোনমিক পারফরম্যান্স আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম বইটি। কয়েক পাতা পড়তেই বাংলাদেশ লেখাটি চোখে পড়ল। বিদেশে বসে এত বড় একজন অর্থনীতিবিদের লেখায় বাংলাদেশের উদাহরণটা দেখতে পাওয়া এক ধরনের গৌরবের বিষয়। কিন্তু বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে, আর ডগলাস নর্থ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৯৩ সালে। বলতে গেলে ১৯৯১ সালের আগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে লেখার মতো বিষয় খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৯০ সালে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন ছিল খুবই কম। মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ছিল দরিদ্র। বাংলাদেশ ছিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি। তদুপরি, দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সেনা শাসন সুখকর কিছু ছিল না মোটেও। তাই ওই সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন হয়নি। ডগলাস নর্থের বইটি থেকেও ভালো কিছু আশা করিনি।

তবে ডগলাস নর্থ বাংলাদেশ নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে ভালো বা মন্দ কিছুই বলেননি। তিনি বলেছেন, একটি দেশের প্রচলিত ইনস্টিটিউশনস (আইনকানুন, প্রথা বা রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি) মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ নিয়ামকগুলো মানুষের প্রাত্যহিক আচরণের অনিশ্চয়তা দূর করে মানুষের ব্যবহারকে অনেকটাই অনুমানযোগ্য করে তোলে। যেমন একজন মানুষ তার বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে কীভাবে অভিবাদন করবেন, ড্রাইভার কীভাবে গাড়ি চালাবেন, একজন ক্রেতা ফল কিনবেন কীভাবে, টাকার লেনদেন করা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মরদেহ সত্কার করাসহ নানা কাজ সম্পাদন করার রীতিনীতি সবারই প্রায় জানা। কিন্তু কাজগুলোই যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো দেশে, ধরুন বাংলাদেশে করা হয়, তবে আইনকানুন, প্রথা, সংস্কৃতির যে বিস্তর ফারাক তা সহজেই বোঝা যাবে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে নিয়মিত পরিশোধ করার সংস্কৃতি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নিয়মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর তফাত। ডগলাস নর্থের মতে, তফাতের মূল কারণ হলো দেশের প্রচলিত আইনকানুন এবং সে দেশের লালিত প্রথা বা সংস্কৃতি। আইনকানুন সংস্কৃতিই পার্থক্য গড়ে দেয় দুটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের।

আরেক মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফরি ডি স্যাক্স তার ২০০৬ সালে প্রকাশিত দ্য এন্ড অব পভার্টি বইয়ে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন একদম অন্যভাবে। তার বইয়ের একটা অংশে স্বল্প পরিসরে লিখেছেন বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশ: উন্নয়নের সিঁড়িতে স্যাক্স তার বই লেখার আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সকালবেলা তিনি ঘুম থেকে উঠে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে দেখলেন সারি সারি মানুষ, যাদের অধিকাংশই অল্পবয়সী মেয়ে, টিফিন ক্যারিয়ার হাতে করে চলছে কর্মক্ষেত্রে। এরা সবাই পোশাক শ্রমিক। এদের চলার গতির মধ্যে স্যাক্স দেখেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকার ছুটে চলার সাদৃশ্য। বাংলাদেশ নিয়ে স্যাক্স তার লেখা শেষ করেছেন অনেকটা এভাবে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিঁড়ির প্রথম সারিতে, এটা সম্ভব হয়েছে তার নিজস্ব বীরত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপের কারণে। পদক্ষেপ যদি বাংলাদেশ উন্নয়নের লাইনে রাখতে সমর্থ হয়, তবে দেশ একদিন উন্নয়নের উদাহরণ হবে।

ঠিক এমনটাই দেখা গেছে উন্নয়ন অর্থনীতির প্রখ্যাত লেখক মাইকেল পি তোদারো স্টিফেন সি স্মিথের সমাদৃত বই ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের ২০২০-এর সংস্করণে। তাদের নতুন সংস্করণের বইয়ে কেস স্টাডি হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা বা পিছিয়ে পড়ার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটির আগের সংস্করণে ছিল ব্রাজিলের উদীয়মান অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা। এবার স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার যে বর্ণনা বইটিতে রয়েছে, তা শুধু উন্নয়ন অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য রয়েছে অনেক দিকনির্দেশনা।

আলোচনাটা মূলত শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যকরী পরিমাপক কী, সেই সূত্র ধরে। প্রথাগতভাবে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন হচ্ছে উন্নয়নের মাপকাঠি। কিন্তু এটা একটা মানদণ্ড মাত্র। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের বাইরেও অনেক উপাদান আছে, যেগুলো একটি দেশের উন্নয়নকে নির্দেশ করে। যেমন মানব উন্নয়ন সূচক একটি কার্যকরী নির্দেশক। মানব উন্নয়ন সূচকে গত দুই দশকে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকদূর। পাকিস্তান পিছিয়ে না পড়লেও অগ্রগতি হয়নি আশানুরূপ। ১৯৯৫ সাল থেকেই মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের ওপরে। যদিও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল পাকিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনের ৭২ শতাংশ। রকম আরো অনেক নির্দেশক আছে, যেখানে বাংলাদেশ এগিয়েছে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। কিন্তু শুরুটা রকম ছিল না মোটেও।

বাংলাদেশ পাকিস্তানের পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ অন্য কারণে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তান ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত, বাংলাদেশের চেয়ে তো বটেই, কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও। এর প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের বন্দর সুবিধা ব্যবসা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ব্রিটিশ রাজের। সে কারণে উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কলকারখানা তত্কালীন ভারত উপমহাদেশের পাকিস্তান অংশেই গড়ে ওঠে। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে আলাদা হলেও দাপ্তরিক প্রশাসনিক কাজকর্ম পাকিস্তানেই কেন্দ্রীভূত ছিল। বাংলাদেশের সম্পদ পাকিস্তানে স্থানান্তরসহ বাংলাদেশের মানুষ নানা রকম শোষণের শিকার হয় এবং দুই দেশের অসম উন্নয়ন বাংলাদেশকে কোণঠাসা করে ফেললে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বহুদিনের শোষণের শিকার বাংলাদেশ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ গড়ার সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি বা বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই উন্নয়ন সম্ভব এমনতর নেতিবাচক মন্তব্য বাংলাদেশকে নিয়ে ছিল চারপাশে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশের তুলনায় তা ছিল অনেক কম। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড় শুরু পাকিস্তান চেয়ে অনেক পিছিয়ে থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন পাকিস্তানের চেয়ে বড়, এটা বোধগম্য যে বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে অর্থনীতির এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের গল্পটা ঠিক উল্টো না হলেও নিঃসন্দেহে দেশটি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে চরমভাবে।

বাংলাদেশের আশানুরূপ উন্নয়ন হয়েছে দারিদ্র্য বিমোচন শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে, যদিও দরিদ্র চরম দরিদ্রের হার বাংলাদেশে পাকিস্তানের চেয়ে এখনো বেশি। শিক্ষায় বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে বাংলাদেশে আর পাকিস্তানে বেড়েছে সামরিক ব্যয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের, যা একটি চরম অনিশ্চয়তায় পূর্ণ একটি দেশ। পাকিস্তানের তাই সামরিক বরাদ্দ অনেকটাই বেশি। আবার পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্য এসেছে বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। তবে ২০১৭ সালের পর উন্নয়ন সাহায্য পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি পেয়েছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশে যেমন জনসংখ্যার সিংহভাগ একই নৃগোষ্ঠী, পাকিস্তানের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উপজাতি। এদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামি, যা শিক্ষা সম্প্রসারণে, বিশেষ করে কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার হ্রাসে বড় ভূমিকা রয়েছে কিছু এনজিওর, যেমন ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি। শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে পাকিস্তানের চেয়ে বরাবরই কম, মানুষের গড় আয়ু সবসময়ই পাকিস্তানের চেয়ে বেশি।

বইটিতে উন্নয়নের পরিসংখ্যান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আশানুরূপ উন্নতি করতে না পারার কিছু প্রসঙ্গ। দুই দেশের সেনা শাসনের ক্ষত এক না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে রয়েছে দীর্ঘ সময় সেনা শাসনের ইতিহাস। আইনের শাসন বিচার ব্যবস্থায় দুই দেশের মধ্যে দৃশ্যত কোনো পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করলেও গত কয়েক বছর তা ব্যাহত হয়েছে অনেকটাই। উন্নয়নের পাশাপাশি বেড়েছে ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য। বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ যেসব অঙ্গ, যেমন বিচার নির্বাহী বিভাগের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিধি কমে যায় এবং জবাবদিহিতা খর্ব হয়। জেফরি ডি স্যাক্স তার বইয়ে ঠিক এসব নিয়ামকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, বাংলাদেশ যদি উন্নয়নের প্রথম ধাপ অতিক্রম করে ওপরে উঠতে চায়, এসব নিয়ামকের আমূল সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। দেশের নীতিনির্ধারকরা এগুলো আমলে নিয়ে যথাযথ সংস্কার করলেই বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। তবেই বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের উন্নয়নের মডেল। 

 

. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, ফাইন্যান্স অর্থনীতি বিভাগ, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন