উচ্চশিক্ষা

শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়, উন্নয়ন ও মেধার বিকেন্দ্রীকরণ

মো. রবিউল ইসলাম

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক অনুন্নয়ন আন্তর্জাতিক সূচকে এদের অস্তিত্বের হাহাকার প্রমাণ করে যে গত ১০০ বছরেও বাংলাদেশী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত বা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। যেখানে ১৯৭৩-এর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে পরিচালিত চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি, সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আবির্ভাব হয়েছে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; যেগুলো মূলত পিছিয়ে পড়া বিভাগ অথবা জেলা পর্যায়ে স্থাপিত হয়েছে এবং হয়ে যাচ্ছে গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে। এগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হয়, এসব যত না শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বোধ হয় এগুলো একেকটা পলিটিক্যাল প্রজেক্ট। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অবকাঠামো, যোগ্য শিক্ষক, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অভিজ্ঞ দক্ষ শিক্ষা প্রশাসনের অভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভোগাচ্ছে চরমভাবে। কিছু রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান সুযোগসন্ধানী শিক্ষক লিয়েনে এসব বিদ্যাপীঠে যান শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি হিসেবে। ভিসি, প্রোভিসি বা রেজিস্ট্রার পদে লিয়েনে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করেন ঠিকই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নের দিকে নজর দেন না। এমন প্রমাণ সাম্প্রতিককালে নেহাত কম নয়। তাদের এমন অবহেলা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ভর্তি বাণিজ্য করেন জোরেশোরে। এগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মুক্ত করে সঠিক একাডেমিক উন্নয়নের ধারায় নিতে না পারলে এগুলো অদূরভবিষ্যতে স্থানীয় কলেজের লেভেল বা তার নিচে চলে আসবে।

উল্লিখিত বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুণী শিক্ষক আছেন, যাদের স্থায়ী বা জন্মনিবাসে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতি সেগুলো সুবিচার করতে ব্যর্থ হচ্ছে দক্ষ অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং নিবেদিত যোগ্য শিক্ষক-প্রশাসকের অভাবে। অভাব নিরসনের জন্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো এক বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে। তারা প্রণোদনা বদলির সুযোগ দিয়ে স্থায়ী অস্থায়ীভাবে বড় চারটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র যোগ্য শিক্ষকদের তাদের নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ খুলে দিতে পারেন এবং যাওয়ার জন্য উৎসাহ জোগাতে পারেন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে ডিগ্রি করে সদ্য ফেরত আসা শিক্ষকরাও যেন এমনভাবে তাদের নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভিস দিতে পারেন, সে সুযোগ রাখতে হবে। অর্থাৎ তাদের যেন নিজের কর্মস্থল-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটির সমপরিমাণ সার্ভিস দিতে বাধ্য না করে তার নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভিস দিলেই সেটা যেন গণনায় নেয়া হয়। কারণ দিন শেষে ওই বিদেশফেরত শিক্ষক তার সার্ভিস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই দিচ্ছেন, অন্য কোথাও নয়। আর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থই পাবলিক মানি এবং তা সরকারি বাজেট থেকেই আসে।

অথবা আরেকটা উপায় হতে পারে। যেমন ছোট নবীন আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাটেলাইট বা আঞ্চলিক ক্যাম্পাস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। যেমন মাল্টি ক্যাম্পাস সিস্টেম অস্ট্রেলিয়ায় বা হংকংয়ে আছে। এতে অনেক শিক্ষক, যারা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সম্মান বা মর্যাদার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে চান না, তখন তাদেরও এসব বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক ক্যাম্পাসে আসতে বিব্রত বা অরাজি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এতে আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে এবং প্রশাসনিক জটিলতা খরচ কমবে।      

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষকতা যত না চাকরি, তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা বা ব্রত। দর্শন মাথায় রাখলে যোগ্য শিক্ষকের সার্ভিস পাওয়ার প্রথম নৈতিক দাবিদার তার নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নৈতিকতা ধারণ করে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী শিক্ষকরা যদি তাদের এলাকার নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে অবদান রাখেন, তবে তার চেয়ে মহৎ কিছু আর হতে পারে না। একজন মেধাবী শিক্ষক যখন তার অর্জিত জ্ঞান, গবেষণা আর শ্রম নিজের এলাকার প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করেন, তবে তা শুধু চাকুরে টাইপের শিক্ষকের সার্ভিসের চেয়ে ঢের বেশি কল্যাণকর হওয়ার কথা। নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সার্ভিস দিয়ে নিজ এলাকাকে যদি উন্নত করা যায়, তবে তা জাতীয় উন্নয়ন আর অগ্রগতিতেও ভূমিকা রাখবে।

অতএব, এমন দেশ বা অঞ্চলপ্রেমের চর্চা শিক্ষক বদলির সংস্কৃতি করতে না পারলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামগুলো শুধু খাতা-কলমে থেকে যাবে। এক্ষেত্রে দক্ষ মেধাবী শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতির জন্য। তারই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রেষণে পাঠানোর নিয়ম সহজ করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে বদলির ব্যবস্থা করতে হবে, যেন অন্তত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষকরা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন সহজেই; তবে তা সুবেহদারি মসনদের (শিক্ষক-আমলার সুযোগ-সুবিধার) জন্য নয়। অথবা বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাল্টি ক্যাম্পাস সিস্টেম চালু করা দরকার। প্রক্রিয়া যেটাই হোক, যেন প্রকৃত একাডেমিক উন্নয়নই হয় এমন নিয়ম প্রবর্তনের একমাত্র উদ্দেশ্য। সংগতকারণেই আশা করতে চাই সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানগুলো অচিরেই এমন মেধার দক্ষতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করবে। তাহলে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কিছুটা মেধা যোগ্যতার ভারসাম্য তৈরি হয়

 

মো. রবিউল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক

আইন বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন