সাগরে তেল-গ্যাস উত্তোলন নিয়ে জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদন

সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে অনুসন্ধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিক জ্বালানি মন্ত্রণালয়

অনেক সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। পাশের দেশ মিয়ানমার ভারত তাদের প্রান্তে সাগরে তেল-গ্যাস আবিষ্কারে অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে। কারণ অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, ভূতাত্ত্বিক, অনুসন্ধান ব্যয়, ঝুঁকি, প্রযুক্তি উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আর্থিক শর্তাবলির বিভিন্ন বিষয়ে সীমাবদ্ধতা। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির জমা হওয়া প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ধীর। কারণে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে, যা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় উৎপাদনে তার প্রভাব পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি তদারকি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা জোগাবে বলে প্রত্যাশা।  

স্বল্পমূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় অর্থনীতির চাকা স্বচ্ছন্দে চালু রেখেছে। ২০১০ সালে এসে গ্যাস সংকট জ্বালানি খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সময়ে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে জ্বালানি সরবরাহের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নকালে নির্ধারিত হয় যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখবে কয়লা, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হবে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে গ্যাস সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। কিন্তু এলএনজি ব্যয়বহুল, এর ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, এলএনজি সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে ব্যাপক ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে। সরকার শুরু থেকেই গ্যাস সংকটের সমাধান হিসেবে আমদানিনির্ভরতার দিকেই বেশি জোর দিয়েছে। সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলন তথা সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। ফলে বাংলাদেশ ক্রমে ব্যয়বহুল আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। ফলে দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বহু আগে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশী ভারত মিয়ানমারের বাধার মুখে ছিল বাংলাদেশ। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের রায়ে প্রায় নয় বছর আগে (২০১২) মিয়ানমারের সঙ্গে এবং সাত বছর আগে (২০১৪) ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়। প্রায় লাখ ৩৮ হাজার ২৮৯ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, যাকে সমুদ্র বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গভীর সাগরের তেল-গ্যাস উত্তোলন নিয়েও তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সম্ভাবনাময় সাগরবক্ষে গ্যাস সন্ধানে কেন স্থবিরতা? কয়েক বছর আগেই প্রতিবেশী ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও এখনো জরিপ অনুসন্ধান কাজ বহুলাংশে আটকে আছে দরপত্র আহ্বানে। বস্তুত সমুদ্রভিত্তিক ব্লু ইকোনমি তথা সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা অনেক হলেও কাজে ততটা এগোনো সম্ভব হয়নি। সুনীল অর্থনীতির সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে যে গবেষণা বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে, তাও সীমিত রয়েছে চট্টগ্রাম থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত উপকূলীয় পর্যায়ে। এমনকি সমুদ্র গবেষণা উপযোগী জাহাজ থাকার মতো ন্যূনতম সক্ষমতার অভাবে বিস্তৃত মহীসোপান থেকে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত গবেষণা শুরু করা যাচ্ছে না। অথচ মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর পরই এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। ওদিকে ভারত মিয়ানমার তাদের সীমানায় গ্যাস অনুসন্ধান, আবিষ্কার, এমনকি উত্তোলনও চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত মিয়ানমারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।

উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড, অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড যৌথভাবে সমুদ্রের একটি ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া সরকার সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান উত্তোলনে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে। শুধু তা- নয়, বিদেশী বিনিয়োগকারী আকর্ষণে পিএসসি নীতিও পরিবর্তন করা হয়। তার পরও সাড়া মিলছে না। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা জয়েন্ট ভেঞ্চারে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলছেন।

গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে উচ্চমূল্যে গ্যাস আমদানি করছে সরকার। স্থলভাগেও কমছে নিজস্ব গ্যাসের মজুদ। তার পরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এরই মধ্যে একাধিক বিদেশী কোম্পানি সাগরে অনুসন্ধান শেষ না করেই চলে গেছে। পূর্ণাঙ্গ জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ ঝুলে আছে কয়েক বছর ধরে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকার কার্যক্রমও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অথচ বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস তুলছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। ভারতও প্রচুর পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করেছে। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকলে বড় বড় কোম্পানি সমুদ্রে অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না। এজন্য মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে ভূতাত্ত্বিক গঠন খনিজ সম্পদের অবস্থানের একটি প্রাথমিক ধারণা মেলে। জরিপের তথ্যই কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে অনুসন্ধানে অংশ নিতে। সার্ভের তথ্য থাকার কারণেই ভারত মিয়ানমার তাদের প্রান্তে অনুসন্ধানের জন্য বড় বড় কোম্পানিকে আকর্ষণ করতে পেরেছে। সময়মতো মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করতে না পারায় বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে অনেকখানি।

গ্যাসনির্ভর শিল্প-কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। গ্যাসচালিত যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। গৃহস্থালি কাজে গ্যাসের ব্যবহার তো আছেই। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। একসময় শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ময়মনসিংহের অংশবিশেষে গ্যাস সরবরাহ ছিল। এখন সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনাসহ আরো অনেক জেলায়ই গ্যাস পৌঁছে গেছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সব শিল্পে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। এজন্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ। স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ বাড়াতেই হবে। সেজন্য প্রয়োজন ব্যাপক অনুসন্ধান উত্তোলনের আয়োজন। আশা করি, বর্তমান সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা উত্তরোত্তর আরো জোরদার করা হবে। সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি আমাদের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তাই স্থলভাগের পাশাপাশি সাগরেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান দ্রুততর করতে হবে। দেশে উন্নয়নের যে গতি সূচিত হয়েছে, তাকে আরো টেকসই বেগবান করতে হলে নিজস্ব তেল গ্যাসের মজুদ কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন