জন্মদিন

‘বাংলাপিডিয়া’র পথিকৃৎ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

খ্যাতিমান ঐতিহাসিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের আজ ৮২তম জন্মদিন। তার অন্যতম কর্মস্থল বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি আজ তাকে বিশেষ সম্মাননা জানাবে এবং উপলক্ষে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আধুনিকীকরণের পথিকৃৎ শীর্ষক ওয়েবিনার আয়োজিত হবে। প্রফেসর ইসলাম ১৯৩৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার থানাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৬১ সালে বিএ অনার্স ১৯৬২ সালে এমএতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন এবং ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। তার আগে তিনি মোমেনশাহী আনন্দমোহন কলেজ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শীর্ষক গবেষণাকর্মের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। অধ্যাপক . সিরাজুল ইসলাম দীর্ঘ ৪০ বছর অধ্যাপনা করে স্বেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে অবসরে যান। কারণ নিজেকে পুরোপুরি গবেষণাকর্মে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে এবং জীবনের বাকিটা সময় দেশের কল্যাণে গবেষণা করার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার পছন্দের গবেষণার স্থান হিসেবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিকে বেছে নেন।

বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার মতো বিশাল কাজের তিনিই উদ্ভাবক বাস্তবায়ক। কারণে বাংলাপিডিয়া সিরাজুল ইসলাম সমার্থকের পর্যায়ে উপনীত হন। বাংলাপিডিয়ার পথিকৃৎ হিসেবেই তিনি পরিকীর্তিত হবেন। তার সমন্বিত প্রচেষ্টায় সম্পাদনায়  বাংলাপিডিয়া ১০ খণ্ডে বাংলা ইংরেজি ভাষাসহ ডিভিডি এবং অনলাইন সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যা এরই মধ্যে দেশের কোটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশী-বিদেশী অসংখ্য গবেষক গ্রন্থ পেয়ে উপকৃত হয়েছেন। বাংলাপিডিয়া ছাড়াও তার সম্পাদনায় এশিয়াটিক সোসাইটির ফ্লোরা ফনা, কালচারাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ছোটদের বাংলাপিডিয়া, ঢাকার ৪০০ বছর প্রকাশিত হয়। এসব প্রকল্পের জন্য অর্থসংস্থান, নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নে তার দক্ষ নেতৃত্ব ছিল প্রবাদসম। তিনি ছিলেন বরাবরই বড় মাপের গবেষক, সংগঠক সৃজনশীল চিন্তাভাবনার পৃষ্ঠপোষক। জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞানগর্ভ গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অবিচল অয়োময় প্রত্যয়কে জাতি সবসময় সম্মান সমীহ করবে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিন খণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১) প্রথম প্রকাশনার সময় প্রকাশনা অনুদান গ্রহণ নিয়ে একটি স্পর্শকাতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যা তিনি অত্যন্ত দক্ষতা সুবিবেচনার সঙ্গে মোকাবেলা করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাপিডিয়া প্রথম প্রকাশের প্রাক্কালেও বেশকিছু স্পর্শকাতর অভিযোগ প্রসঙ্গের বেড়াজাল গজিয়ে ওঠে। সেখানেও তার দৃঢ়চিত্ত অবস্থান প্রচেষ্টা জয়ী হয়েছিল।

তার উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ গবেষণাকর্ম হচ্ছে . বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯০-১৮১৯), . বাংলার ভূমিস্বত্ব: মধ্যবর্তী শ্রেণীর উদ্ভব, . বাংলাদেশের নদী অববাহিকার গ্রামগুলো, . বাংলাদেশের গ্রামীণ ইতিহাস, . ফজলুল হক পরিষদ স্মারক বক্তৃতা, . ভূমি ব্যবস্থা সামাজিক সমস্যা, . ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, . ভূমি ভূমি সংস্কার। ইতিহাসশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ভারতের বিখ্যাত স্যার যদুনাথ সরকার স্বর্ণপদক সম্মাননায় ভূষিত হন এবং গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।

সামুদ্রিক ইতিহাস গবেষণায় অধ্যাপক . সিরাজুল ইসলামের প্রচুর ঝোঁক রয়েছে। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে তার গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক ইতিহাসকে বেছে নেন। ভারত মহাসাগরে আমেরিকানদের আগমনের ইতিহাস তত্সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে ফুল ব্রাইট কমিশন, অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ একাডেমি, কিংস রয়েল কলেজ লন্ডন প্রভৃতি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দ্বারা। সমুদ্রসীমার ইতিহাস এবং সমুদ্রবিজ্ঞানের ওপর তার অনেক মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ দেশী-বিদেশী বহু জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম দেশের বিভিন্ন জেলার ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত ব্রিটিশ সরকারের গেজেটগুলোর ওপর গবেষণা করে ১২ খণ্ডে গেজেটগুলো প্রকাশ করেন. চট্টগ্রাম জেলা গেজেট ১৭৬০-১৭৯০, . কুমিল্লা জেলা গেজেট ১৭৭২-১৭৯০ ( খণ্ডে), . ঢাকা জেলা গেজেট ১৭৭২-১৭৮২ ( খণ্ডে)

ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন একাধারে জ্ঞানগর্ভ গবেষক আবার সরস রচনায় সিদ্ধান্ত। তার লেখায় গবেষণার ফলাফল যেমন থাকত, তেমনি আবার গবেষণা ফল সবাইকে আকৃষ্ট আগ্রহ সৃষ্টির উপাদানে সমৃদ্ধ। তার গবেষণার কেন্দ্রে ছিল কৃষি অর্থনীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বন্দোবস্ত-উত্তর কোম্পানি ব্রিটিশ আমলে ভূমি ব্যবস্থাপনা, ল্যান্ড রেকর্ড সার্ভে আর্থ-প্রশাসনিক বিষয়। তিনি ১৯৭৮/৭৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কমনওয়েলথ ফেলো, ১৯৯০/৯১ সালে সিনিয়র ফুল ব্রাইট, ২০০৪ সালে ব্রিটিশ একাডেমি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে কোম্পানি ব্রিটিশ আমলের আর্থপ্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের গবেষক অথরিটি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়। লন্ডনের রয়েল সোসাইটি অব হিস্টোরিক্যাল স্টাডির তিনিই প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশী ফেলো। ভূমি ব্যবস্থাপনা আর্থপ্রশাসনিক বিষয়ে বহির্বিশ্বে সুপরিচিত তার অন্যতম তিনটি আকরগ্রন্থ Permanent Settlement in Bengal (Dhaka 1979), Villages in the Haor Basin of Bangladesh (Tokyo 1985), Bangladesh Land Tenure (Amsterdam 1983, Calcutta, 1985)

বাংলাদেশের আবহমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ পরিবর্তন প্রয়াস শনাক্ত করেছেন তিনি। একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দেশ হিসেবে বাংলার ছিল নিজস্ব রীতিনীতি, প্রথা, প্রতিষ্ঠান; যা হাজার বছর ধরে বাঙালি সমাজকে একীভূত রেখেছে, দিয়েছে ঐক্য নির্দিষ্ট পরিচয়। কিন্তু কর্নওয়ালিস সমাজকে ভিন্নভাবে পুনর্গঠন করতে চেয়েছেন এবং এজন্য তিনি প্রণয়ন করেন নতুন নতুন আইনকানুন প্রতিষ্ঠান, যেসবের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ...ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো মতেই মোগল সাম্রাজ্যবাদী শাসনের চেয়ে কম স্বৈরাচারী ছিল না। কিছু একটা তফাত ছিল, মোগল স্বৈরাচার ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অভিজাততান্ত্রিক, কিন্তু ব্রিটিশ স্বৈরাচার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক এবং নির্দেশিতভাবে প্রতিযোগিতামূলক। ব্রিটিশ স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা করত একদল পেশাদার আমলা, যারা নিয়ন্ত্রিত হতো আইন উচ্চতর আমলাদের দ্বারা এবং কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা কাজ করত না (যেমনটি দেখা যেত) মোগল স্বৈরতন্ত্রে।

ভারতবর্ষে আধুনিক আমলাতন্ত্রের বিকাশ বৈশিষ্ট্য নির্ণয় সিরাজুল ইসলামের মেধাবী গবেষণাকর্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার মতে, আধুনিক আমলাতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বচ্ছতা অনমনীয়তা। কিন্তু [দীর্ঘসূত্রতা] যুক্ত হয় ব্রিটিশ ভারতীয় আমলাতন্ত্রে। স্থানীয় অফিস থেকে লন্ডন ইন্ডিয়া অফিসে নথিপত্রের অবিরাম পথপরিক্রমায় উদ্যম নতুন প্রবর্তনা নিঃশেষ হয়ে যেত। পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর লেগে যেত এবং অনুমোদন যখন পাওয়া যেত তখন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিত এতটা বদলে যেত যে সিদ্ধান্তটাই অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত। কিন্তু গৃহীত ব্যবস্থাসংক্রান্ত দলিলপত্র আমলাতন্ত্রের রীতিবদ্ধতার নিদর্শন হিসেবে থেকে যেত। আমলাতন্ত্রে সবসময়ই বাহ্যিক নিয়মনীতির জয় হয়েছে এবং এর অন্তর্নিহিত মর্মবাণী হয়েছে উপেক্ষিত। যদিও মোগলরা নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় বহিরাগত ছিল, ভারতে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল এবং স্থানীয় প্রথাগত ঐতিহ্য এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী ভারতীয় এলিটদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সাম্রাজ্য শাসন করত। অন্যদিকে ব্রিটিশরা সাগরের পরপার থেকে তাদের নিয়োজিত কনসাল সিভিল সার্ভেন্টদের মাধ্যমে একটি কলোনি হিসেবে তাদের দখলকৃত রাজ্য শাসন করত। তত্কালীন পরিবহন ব্যবস্থার নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সরাসরি সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বাবধান করা তখন সম্ভব ছিল না। অন্যান্য সমসাময়িক শক্তি নিজ নিজ অধিকৃত অঞ্চল শাসনের জন্য যে আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিল, তার সঙ্গে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা আমলাতন্ত্রের কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। এটি ছিল একটি বিশেষ ধরনের আমলাতন্ত্র। এর প্রধান কারণ ছিল পৃষ্ঠপোষকতার ওপর ভিত্তি করে সিভিল সার্ভিসের রিক্রুটমেন্ট, নানা উৎস থেকে এবং নানা নিয়মের অধীনে সিভিল সার্ভিসের রিক্রুটমেন্ট হওয়ায় সার্ভিসে কোনো সময়ই অন্যান্য আদর্শ আমলাতন্ত্রের মতো esprit de corps গড়ে উঠতে পারেনি। সিভিল সার্ভিস সমাজ শক্তিশালী পেশাদার সংগঠনে রূপান্তর না হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে নানা স্বার্থগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত প্রধানত শ্বেতাঙ্গ রাখার নীতি এবং যুদ্ধোত্তরকালের পরিবর্তিত আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিভিল সার্ভিসকে হঠাৎ করে ভারতীয়করণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় অতিশয় বক্র বিকৃতভাবে। উপসংহার টানেন তিনি এই বলে, ব্রিটিশ সরকার সচেতনভাবে ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে একটি দুর্লঙ্ঘ্য-দুর্নিবার সংগঠনে পরিণত করার চেষ্টায় সফল বলে প্রতীয়মান হলেও সিভিল সার্ভিস ক্রমে গতিহীন, গতানুগতিক নিয়ম-নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্র একটি আড়ষ্ট, নিষ্প্রাণ যন্ত্রে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের ভূমি সংস্কার সম্পর্কে তার গবেষণার সারাৎসার হলো, নবাব মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-১৭২৭) পরগণাভিত্তিক জমিদারির বদৌলতে চাকলা বা প্রদেশভিত্তিক একচেটিয়া জমিদারি সৃষ্টি করে ভেবেছিলেন একটি মহাকল্যাণকর সংস্কার সাধন করেছেন তিনি। কর্নওয়ালিসের চোখে ওই একচেটিয়া জমিদার পরিবারগুলো ছিল সমস্ত অকল্যাণের আকর। এগুলোকে ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করে তিনি আরেক ধরনের সংস্কার সাধন করেন। তার ভাষায়, সূর্যাস্ত আইন দেশের ভূম্যধিকারী সমাজে আনবে নতুন গতি, নতুন রক্ত পুঁজিবাদী পরিবর্তন। কিন্তু পুঁজিবাদী পরিবর্তন আসেনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ঔপনিবেশিক সরকার জোতদার শ্রেণীকে কাঁধে তুলে নেয় গ্রামাঞ্চলে পুঁজিবাদী পরিবর্তনে নেতৃত্বদানের জন্য। জোতদার শ্রেণীর স্বার্থে প্রণীত হয় ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন। কিন্তু কৃষিতে পুঁজিবাদী সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, বরং আরো পাকাপোক্ত হয় প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক। ১৯৩০-এর দশকে আন্দোলন শুরু হয় লাঙল যার জমি তার ১৯৫০ সালে প্রণীত আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়, কিন্তু লাঙল যার তার কাছে জমি ফিরে যায়নি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর কয়েক দফা ভূমি সংস্কারের পরও দেখা যাচ্ছে যে যার লাঙল তার কাছে জমি যাচ্ছে না। কৃষককুলের অর্ধেকেরও বেশি এখন ভূমিহীন। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমির সুষম বণ্টন সম্ভব নয়। দেখা গেল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভূমিহীনকে ভূমি দেয়া যেতে পারে বটে, তবে আর্থসামাজিক প্রক্রিয়ায় সে ভূমি ফের কৃষি মোড়লদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে বাধ্য। এর কারণ আধুনিক প্রযুক্তি বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থ। দেশের রাজনৈতিক প্রাযুক্তিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে আসে ভূসংস্কারের প্রকৃতি। ভূমির মালিকানা যদি সরকারের কাছে ন্যস্ত থাকে, অর্থাৎ ভূমিতে যদি ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকে, প্রযুক্তি যদি সেকেলে হয়, তবে ভূমি সংস্কার মানে হবে বড়জোর ভোগ দখলকারের রাজস্ব নিরিখ নির্ণয়, যেমন হয়েছে মোগল আমলে। জমির মালিক রাষ্ট্র কৃষকের মধ্যবর্তী কোনো শ্রেণী হলে ভূমি সংস্কার মানে হবে প্রজার স্বত্ব বিচার, খাজনার তারতম্য, উত্খাত প্রশ্ন, ভূমি ব্যবহার বিধি ইত্যাদি। যেমন হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে। জমির মালিক যদি কৃষক হন, তবে ভূমি সংস্কারের মুখ্য লক্ষ্য হবে কৃষকের মালিকানা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ ভূমিতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রোধ করা, ভূমিহীনকে ভূমি দান ইত্যাদি। যেমন পঞ্চাশোত্তর সংস্কারগুলো।

তার মতে, ভূমির উৎপাদন বৃদ্ধি উৎপাদনের সুষম বণ্টন আধুনিক ভূমি সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছার দুটি প্রধান স্বীকৃত পথএকটি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাদী পথ, অন্যটি সমাজতান্ত্রিক পথ। নতুন সমাজ ব্যবস্থা পত্তনেও রয়েছে ভূমি ব্যবস্থাপনার ভূমিকা।

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন