চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারের নকশাবহির্ভূত র‍্যাম্পের পিলারে ফাটল

অভিযোগ খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে দেশে ফ্লাইওভারসহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিছু অবকাঠামো ভুল নকশায় নির্মাণ হয়েছে। কাজের  মধ্যে নকশা পরিবর্তনের উদাহরণও রয়েছে। ফলে নিয়মিত বিরতিতে ওইসব অবকাঠোমায় নির্মাণ-পরবর্তী নানা ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। কোথাও ফ্ল্যাপ দেবে যাচ্ছে, কোথাও দেখা যাচ্ছে ফাটল। সোমবার চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের একটি পিলারেও ফাটল দেখা দিয়েছে। যে পিলারে ফাটল দেখা গেছে সেটি নির্মাণ করা হয়েছে নকশাবহির্ভূতভাবে। এতে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। বড় দুর্ঘটনা এড়াতে আপাতত সেখানে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না হলে অন্য পিলারগুলোয়ও ফাটল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি খতিয়ে দেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য।

বন্দরনগরীতে যানজট নিরসনে আলোচ্য ফ্লাইওভার নির্মাণ করে সিডিএ। নির্মাণকালেই ২০১২ সালের নভেম্বরে এর গার্ডার ধসে ১৬ জন নিহত হয়। কিন্তু ফ্লাইওভার কার্যকর না হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের দাবির মুখে চার বছর পর আরাকান সড়কমুখী র‍্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মূলত র‍্যাম্পের পিলারেই সম্প্রতি দেখা দিয়েছে ফাটল। এর পেছনে কয়েকটি কারণ দায়ী বলে চিহ্নিত হয়েছে। র‍্যাম্পটি মূল নকশায় ছিল না। নির্মিত ফ্লাইওভারে কোনো ধরনের সমীক্ষা এবং সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল এটি। নির্মাণ ত্রুটিরও আশঙ্কা রয়েছে এতে। সিডিএর তত্ত্বাবধানে র‍্যাম্পটি নির্মাণ করে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এখন নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগ উঠছে। তদুপরি সেখানে ছিল না কোনো স্কেল ম্যানেজমেন্ট। কত লোডের গাড়ি চলাচল করতে পারবে, সেটি নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। অবাধে চলেছে ভারী যানবাহন। এছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করার অভিযোগও আছে সেখানে। সব মিলিয়ে ওই র‍্যাম্পের পিলারে আজকের ফাটলের সূত্রপাত। 

শহরের যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণ একটি বৈশ্বিক চর্চায় রূপ নিয়েছে। অনেক বড় বড় শহরে নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাইওভার। ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, হায়দরাবাদ, আহমেদাবাদ প্রভৃতি শহর, জাপানের টোকিও, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে রয়েছে ফ্লাইওভার। চীনেও অনেক ফ্লাইওভার বিদ্যমান। বিশেষ করে বেইজিং সাংহাইয়ের আঁকাবাঁকা ফ্লাইওভারগুলো নগর অবকাঠামোয় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। যানজট কমিয়েছে। গতি এনেছে নগরজীবনে। অথচ কেবল পার্শ্ববর্তী কলকাতা বাদে আজ পর্যন্ত উল্লিখিত দেশগুলোর কোনো শহরেই ফ্লাইওভারে নকশা-নির্মাণজনিত দুর্ঘটনা ত্রুটির খবর মেলেনি। মূলত যথাযথ পরিকল্পনা, সঠিক নকশা, গুণগত নির্মাণকাজ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। কাজেই ওইসব দেশের প্রকৌশলগত নির্মাণচর্চা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

আরাকান সড়ক অংশের র‍্যাম্পের পিলারে ফাটল সৃষ্টি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সিডিএ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। সিডিএ বলছে, তারা বেশ আগেই সিটি করপোরেশনকে র‍্যাম্পটি নির্মাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে, হস্তান্তর করেছে। এটি দেখভালের দায়িত্ব এখন সিটি করপোরেশনের। ফাটলের জন্য তাদের কোনো দায় নেই। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, সিডিএর তত্ত্বাবধানেই র‍্যাম্পটির নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। মূল নকশার বাইরে গিয়ে তারা এটি নির্মাণ করেছে। কাজেই এর দায় তাদেরই নিতে হবে। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন অবশ্য সিডিএকে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কাজে গাফিলতি ছিল কিনা, নকশায় ভুল ছিল কিনা, তা খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সংস্থাটির। বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এটিকে ফাটল বলে স্বীকার করছে না। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করে গাড়ি চালানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নির্মাণে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ই প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য আমলে নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।

বলা হচ্ছে, ফ্লাইওভারটি হস্তান্তরের সময় র‍্যাম্পটির ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল নিষেধ করা হয়েছিল। একটা সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডও স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সাইনবোর্ড সরিয়ে শহর এলাকার হালকা যানবাহনের পাশাপাশি ভারী যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দেয়। র‍্যাম্পটির প্রস্থ সাড়ে ছয় মিটার হলেও এর ওপর দিয়ে বড় বড় লরি ট্রাক চলাচল করে। ফ্লাইওভারটি বর্তমানে বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। মাঝে মাঝে ভারী লরি-ট্রাক চলাচলের সময়ে ফ্লাইওভারটিতে কম্পন শুরু হলেও বিষয়টিকে তেমন একটা আমলে নেয়া হয়নি। এখন যে ফাটল দেখা দিয়েছে সেটিকে আর হালকভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সংস্কারের জন্য বুয়েটের সঙ্গে ফিজিবিলিটি টেস্ট করে সমস্যা বের করে সমাধানের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি বিবেচনায় নেয়া চাই। শুধু সংস্কার করলে হবে না, ফ্লাইওভারটির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও নিশ্চিত করা জরুরি।

দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে অদক্ষতা নকশার ত্রুটির অভিযোগ এটিই প্রথম নয়। এর আগে ফ্লাইওভারে ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছিল রাজধানী ঢাকায়ও। ২০১১ সালে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের তিনটি ফ্ল্যাপ দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় ফ্লাইওভারটি বন্ধ রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছিল। অন্যদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারেও রয়েছে নকশাগত ত্রুটি। বর্তমানে ত্রুটি নিয়েই ফ্লাইওভারটি দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। বিপর্যয় এড়াতে সতর্কতা হিসেবে রাখা হয়েছে সিগনাল বাতির ব্যবস্থা। এটা সাময়িক মাত্র, দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা নয়। কাজেই বিদ্যমান ফ্লাইওভারগুলোয় কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে, সেটি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। ভবিষ্যতে অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি অবকাঠামোর দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে নকশা থেকে নির্মাণ প্রতিটি পর‍্যায়ে আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রকৌশলগত চর্চার সন্নিবেশ ঘটাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন