আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে প্রভাব নিয়ে সংসদীয় কমিটির উদ্বেগ

সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কারণ বিদ্যুতের একটা বড় অংশ উৎপাদন করা হয় আমদানীকৃত জ্বালানি দিয়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরো বাড়বে। বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে আনতে নানা সুপারিশও করেছে তারা। স্বল্প সময়ে অপচয় কমিয়ে আনাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যয়বহুল একক উৎস নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎস থেকে স্বল্প ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। প্রত্যাশা থাকবে, বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মহাপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনবে।

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সক্ষমতার ৩৫ শতাংশই আসার কথা আমদানিনির্ভর গ্যাস এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এছাড়া বিদ্যুতের একটি বড় অংশ আসবে আমদানিনির্ভর কয়লা জ্বালানি তেল থেকে। নবায়নযোগ্য উৎস বা দেশীয় উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা পরিকল্পনায় তেমন জোর লক্ষ করা যাচ্ছে না। টার্মিনাল নির্মাণ, পাইপলাইন স্থাপনসহ এলএনজি ঘিরে পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়, বিপুল বিনিয়োগ পরিকল্পনাও রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এলএনজির দাম কম থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দামও দফায় দফায় বাড়ছে। আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা এলএনজির ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এলএনজি, জ্বালানি তেল প্রভৃতির বাজার অস্থিতিশীল। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে। কোনো কারণে এলএনজি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যাবে। এটিই সত্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে উৎপাদন খরচ আয়ের মধ্যে ঘাটতি আরো বাড়বে। এখন সরকার যদি ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে চায়, তাহলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শঙ্কা রয়েছে।

বৈশ্বিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে মোট বিদ্যুতের যথাক্রমে ৩১ ২৬ শতাংশ উৎপাদন করছে। দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জলবিদ্যুতের অবদান ৪১ শতাংশ। বাকি শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে। এখন দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহারে আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইভাবে কম্বোডিয়াও গতানুগতিক দেশীয় জ্বালানি উৎসের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা। দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে জলবিদ্যুৎ জিওথার্মালের ব্যবহার বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে তারা দেশীয় উৎসনির্ভর। ফলে সেসব দেশে জ্বালানি ব্যয় আপেক্ষিকভাবে কম। এসব দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে আমাদেরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ দিতে হবে। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কেমন, তা নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা হয়নি, গবেষণা হয়নি। ধরনের  গবেষণা বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা সংশোধনপূর্বক দেশীয় উৎসনির্ভর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য সম্পদ ব্যবহারে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার সবসময়ই দোদুল্যমান। ফলে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একক জ্বালানি নির্ভরতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জল স্থলভাগে আরো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটির সদ্ব্যবহার প্রয়োজন। জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হলে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের কাজ বেগবান করতে হবে। বাস্তবতা হলো, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। জলসীমার আইনি মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমার ভারত বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ অনেকটা সময় পার হলেও আমাদের দেশে এটি করা হয়নি। এটি দ্রুত শুরু করতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ জাতীয় সক্ষমতা উভয়ই বাড়াতে হবে। দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে, ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। 

সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি পরিকল্পনা অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভর। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয়বহুল আমদানিনির্ভরতা জ্বালানিনির্ভরতা টেকসই অর্থনীতি উন্নয়নের সহায়ক নয়। সরকার যেখানে রফতানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে উৎপাদন ব্যয়কে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে রাখতে হবে। আর সেটি অর্জন করতে অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক দামে নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যা আমদানিনির্ভরতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে যদি এলএনজি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়, নির্মিতব্য বৃহৎ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি শুধু আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল হয়, যদি আমদানি করা তেলের ওপর বাড়তি নির্ভরশীলতা কমানো না যায় এবং যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ানো যায়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি হবে আমদানিনির্ভর। এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপর যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে, তা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লাসহ সব জ্বালানির সুষ্ঠু ব্যবহার, জ্বালানি অনুসন্ধান এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। সাশ্রয়ী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদিভাবে দেশের জনগণ বা গ্রাহকদের কাছে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ জ্বালানির প্রাপ্যতাই হলো জ্বালানি নিরাপত্তার প্রধান লক্ষ্য। অনবায়নযোগ্য নিজস্ব জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং কয়লা উত্তোলন আহরণ যথাযথভাবে না করা হলে শুধু আমদানিনির্ভর জ্বালানি ব্যবহারে কখনো সাশ্রয়ী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদিভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন