সময়ের ভাবনা

স্থানিক পরিসরে পরিবর্তন আনছে সোস্যাল মিডিয়া

নূসরাত জাহান মীম

সোস্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে কিছু শক্তপোক্ত পরিবর্তন এনেছে। যোগাযোগ আজকাল ভীষণ সহজ। ছবি, ভিডিও, তোলপাড় করা স্ট্যাটাস কিংবা নিছক মজা করা মিমসামাজিক প্রেক্ষাপটে সবগুলোই তৈরি করছে নতুন নতুন সম্পর্কের বুনিয়াদ, বিস্তার, নয়তো টানাপড়েন। ব্যক্তিগত কালক্ষেপণ থেকে শুরু করে সমষ্টিগত ইভেন্ট ক্রিয়েশনসবখানেই সোস্যাল মিডিয়া কিছু মাপকাঠি তৈরি করে দিচ্ছে, যা প্রতিফলিত হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে। বন্ধুদের নিয়ে কোথাও খেতে গেলে আজকাল খাওয়াদাওয়া কিংবা আড্ডাবাজির চেয়ে মুখ্য হয়ে পড়ে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করার জন্য ছবি তোলা। ফিয়ার অব মিসিং আউট জন্ম দিচ্ছে সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নিয়ে বুঝে বা না বুঝে দেয়া হাজার হাজার স্ট্যাটাস। মুহূর্তের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে গতকালের ভাইরাল হওয়া কোনো প্রতিভা, ঘটনা কিংবা প্রতিবাদ। আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সোস্যাল মিডিয়া কী কী পরিবর্তন আনছে, তা নিয়ে লেখালেখি গবেষণা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। তবে আমাদের চারপাশের স্থানিক জগতের ওপর সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে আলোচনা এখনো সীমিত পরিমণ্ডলে রয়ে গেছে। লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য ছোট্ট একটি স্থানিক পরিসরে কীভাবে সোস্যাল মিডিয়া বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা।

এক বছর ধরে আমি এবং আমার তিন টিমমেট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে সাদাফ সুমাইয়া খান দীপান্বিতা নন্দী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে অরুন্ধতী দে) কাজ করছি ঢাকায় ফেসবুকনির্ভর অনলাইন বিজনেসে যুক্ত আছেন এমন মেয়েদের নিয়ে, যারা মূলত নিজেদের বাড়ি/ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাদের বিজনেস সামলান। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম তারা কী করে তাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, যা কিনা শুধু বসবাসের জন্য ডিজাইন করা, সেখানে পুরোদমে ব্যবসা করছেন; ফেসবুকে লাইভে এসে কাস্টমারদের প্রডাক্ট দেখাচ্ছেন; প্রডাক্ট স্টোরিং প্যাকেজিং করছেন। কেউ কেউ ক্যাটারিং সার্ভিস দিচ্ছেন। নিমের তেল থেকে শুরু করে সাতকড়ার আচারসবই বাসায় তৈরি করছেন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে বিক্রি করছেন। অর্থাৎ তাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো শুধু আবাসন-এর গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট প্রডাকশন ইউনিট হয়ে গেছে। বাড়িতে থেকে উপার্জনের সুযোগ, স্বাধীনতা কিংবা প্যাশনের জায়গাটা ধরে রাখতে বর্তমানে হাজার হাজার মেয়ে যুক্ত হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ানির্ভর অনলাইন ব্যবসায়। বদলে যাচ্ছে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের (ভাড়া বা নিজস্ব) চেহারা, ব্যবহার এবং স্থানিক বৈশিষ্ট্য। যেমন আমাদের কেস স্টাডিগুলোয় উঠে এসেছে কী করে বেডরুম হয়ে গেছে স্টোররুমের মতো, ড্রইংরুম হয়ে গেছে ফেসবুক লাইভে যাওয়ার স্টেজ, ছোট্ট রান্নাঘর আর ডাইনিং রুমে চলছে শত মানুষের খাবার তৈরির প্রস্তুতি। এই সাম্প্রতিক সোস্যাল মিডিয়া উদ্ভূত পরিবর্তনটি সত্যিকার অর্থেই মডার্ন হাউজিং ডিজাইন-এর একদম গভীরে গিয়ে নাড়া দিয়েছে এবং আমাদের চোখের সামনে আবারো তুলে ধরেছে মডার্ন ডিজাইন থিংকিংয়ের সীমাবদ্ধতা।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ভারতীয় উপমহাদেশে নগর পরিকল্পনা স্থাপত্য আলোচনায় পশ্চিমা আধুনিক চিন্তাধারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। একদিকে উন্নয়নের চাকা দ্রুত ঘোরাতে দরকার ছিল শহরকেন্দ্রিক শিল্পায়নের বিস্তার। অন্যদিকে দরকার হয়ে পড়েছিল শিল্প-কারখানায় কাজ করতে গ্রাম থেকে শহরে আসা বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসন জোগান দেয়া (যা আজও ঢাকা শহরের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ) পশ্চিমা বিশ্বের আধুনিকায়নের মডেল অনুসরণ করে অঞ্চলেও শুরু হলো কর্মক্ষেত্র থেকে আলাদা আবাসন কর্মসূচি, যেখানে আবাসন বলতে বোঝায় এমন জায়গা, যেখানে সারা দিন শিল্প-কারখানায় কাজ শেষে কর্মীরা এসে বিশ্রাম নেবেন, খাওয়াদাওয়া করবেন। তাদের পরিবারের জন্য তৈরি হলো স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। অর্থাৎ শহরজীবনে একেকটা কাজের জন্য নাগরিকদের একেকটা জায়গায় যেতে হবে। প্রোগ্রাম/ফাংশন-নির্ভর শক্তপোক্ত স্থানিক পৃথকীকরণ পশ্চিমা বিশ্বে প্রকট হলেও আমাদের দেশে হয়নি। তবে সেদিকেই নগর পরিকল্পনা এগোচ্ছে। ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না খারাপ, সে বিষয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক চলছে। আমরা সেদিকে না যাই। আবাসন বিষয়ে ফিরে আসি। যদিও নগরে স্থানিক পৃথকীকরণ পশ্চিমা বিশ্বের মতো প্রকট নয়, তবে উদীয়মান শহরগুলোর মতো ঢাকাও আত্মস্থ করল মডার্ন অ্যাপার্টমেন্ট লিভিং অ্যান্ড ডিজাইন কনসেপ্ট। সীমিত পরিসরে যৌক্তিক উপায়ে শহরের নিম্ন উচ্চমধ্যবিত্তদের আবাসনের জন্য গড়ে উঠতে থাকল একের পর এক বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। যার প্রধান ব্যবহার (ধরেই নেয়া হয়) কাজ থেকে ফিরে বিশ্রাম, রান্না, খাওয়াকিছুটা সামাজিক আচার পালন। স্ট্রাকচারাল/কাঠামোগত ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল/অবকাঠামোগত কার্যকারিতা অক্ষুণ্ন রাখতে একই ফ্লোর প্ল্যান কপি-পেস্ট করে বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। যেহেতু বাবহারিক চাহিদাও সবার একই রকম, মোটামুটি সবারই দৈনিক কর্মসূচি একই প্যাটার্নের, তাই ঢালাওভাবে একই ধাঁচের অ্যাপার্টমেন্ট ডিজাইনে কোনো বাধা ছিল না। তবে আলো-বাতাস চলাচল, আরামদায়ক তাপমাত্রা, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে সামাজিকীকরণের সুযোগ ইত্যাদি বরাবরই ভালো, আধুনিক স্থাপনার বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে।

সমস্যা শুরু হলো তখন, যখন সোস্যাল মিডিয়ানির্ভর অনলাইন বিজনেস ট্রেন্ডি হয়ে উঠল। আগেও বলেছি, অ্যাপার্টমেন্টগুলো এখন শুধু আবাসনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট প্রডাকশন ইউনিট হয়ে গেছে। কাজেই শুধু আবাসনকে মাথায় রেখে ডিজাইন করা অ্যাপার্টমেন্টগুলো নতুন ফাংশনাল ডিমান্ডগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে স্থানিক টানাপড়েন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী হচ্ছে মেয়েরা, যারা এমনিতেই নানা কারণে ঘরে কিংবা বাইরে স্পেস ক্লেইম করতে পারে না। আমাদের একটা কেস স্টাডি এমন ছিল, যেখানে বাড়ির কারো যেন কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য গভীর রাতে একজন উদ্যোক্তাকে তার প্রডাক্ট নিয়ে লাইভে যেতে হতো। সে সময় তিনি পটেনশিয়াল কাস্টমার বেশি পেতেন না। উপরন্তু, মাঝেমধ্যে অনলাইনে হয়রানির শিকার হতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। অন্য আরেকটি কেসে আমরা দেখেছিলাম একই বিল্ডিংয়ে দুটি ভিন্ন তলায় একই ফ্লোর প্ল্যানের দুটি অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী দুটি পরিবারের একটি অনলাইনে ক্যাটারিং এবং অন্যটি রেডিমেড গার্মেন্টের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। যদিও দ্বিতীয় পরিবার তাদের বারান্দাকে স্টোর রুম বানিয়ে বিজনেস চালিয়ে যেতে পারছে, জায়গা অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থার স্বল্পতার কারণে প্রথম পরিবার তাদের ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়। কিন্তু নতুন জায়গার ভাড়া পুষিয়ে ব্যবসায় লাভ করা কঠিনতর হতে থাকায় তারা কাজ বন্ধ করে দেয়।

শিগগিরই আমরা এমন একটা নাগরিকগোষ্ঠী পাব, যারা নিজেদের বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই বিভিন্ন কাজের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত হবেন। কভিড-১৯ সেই সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মডার্নিস্ট ডিজাইন থিংকিংযা আবাসন এবং কর্মক্ষেত্রকে পৃথকভাবে দেখে এসেছে, একই ধরনের ব্যবহারিক চাহিদা অনুধাবন করে একই ধাঁচের হাউজিং ডিজাইনে স্থপতিদের উদ্বুদ্ধ করেছেতা আজকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমাদের স্টাডিতে যারা অংশ নিয়েছিলেন, এর মধ্যে অনেকেই বলছিলেন তাদের অ্যাপার্টমেন্টে যদি একটা রুম বেশি থাকত কাজ করার জন্য, তাহলে তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। কেউ কেউ বলেছেন, বাড়িওয়ালা যখনই জেনেছেন তাদের অনলাইন বিজনেসের কথা, ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, তাদের ছাদ ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে না আচার/কাপড় রোদে দেয়ার জন্য। অ্যাপার্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি বলেছে, রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিংয়ে বিজনেস করা যাবে না। এমন আরো অনেক স্থানিক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি মেয়েরা হচ্ছে, যার সমাধান শুধু বাড়ি পাল্টে একটা বেশি রুম দিয়ে  সমাধান করা সম্ভব নয়। আমাদের হয়তো সময় এসেছে এর বাইরে গিয়ে ভাবার।

আমরা যারা ডিজাইন প্রফেশনের সঙ্গে যুক্ত আছি, আমাদের উচিত এই নতুন তৈরি হওয়া প্রোগ্রাম-কে ভালোভাবে বোঝা। কারা কীভাবে যুক্ত হচ্ছেন, কতক্ষণ কাজ করছেন, কী কী কাজ করছেন, তাদের সাপ্লাই চেইন কেমন, ডিমান্ড কোন কোন বিষয় দিয়ে অনুপ্রাণিত হচ্ছে, সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো আর কোন কোন নতুন ফিচার আনছে ইত্যাদি সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, যতটা গুরুত্ব দিয়ে আমরা ক্রস-ভেন্টিলেশন, ওয়েস্ট-ওয়াল, এনার্জি এফিসিয়েন্সি দেখি। আমাদের ভাবতে হবে কী করে একজন অ্যাপার্টমেন্টবাসী তার প্রয়োজন অনুযায়ী (কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে) সাময়িক স্থানিক পরিবর্তন আনতে পারেন, যাতে তার কাজ অন্যদের দৈনন্দিন জীবনে বিপত্তি তৈরি করার দায়ে বন্ধ না হয়ে যায়। উপরন্তু, একেক ধরনের কাজ একেক ধরনের স্থানিক বৈশিষ্ট্য দাবি করে। যেমন যিনি অফিসপাড়ায় নিয়মিত দুপুরের খাবার সাপ্লাই দেন তার কাজের জায়গা ভিন্ন হবে যিনি গহনা ডিজাইন করেন তার থেকে। আমাদের ভেবে বের করতে হবে হাউজিং ডিজাইনের কোন কোন প্যারামিটারে পরিবর্তন আনলে আমরা রকম diverse program-এর সঙ্গে ডিজাইনের দিক থেকে সমন্বয় সাধন করতে পারব। আমাদের দেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি বজায় রেখে নতুন আবাসন তবে কেমন হতে পারে?

 

নূসরাত জাহান মীম: ডক্টর অব ডিজাইন ক্যান্ডিডেট, গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন