টেলকোর ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি কি থেমে যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বহুমুখী বৈচিত্র্যপূর্ণ সেবা দিয়ে বিশ্বব্যাপী টেলিকম অপারেটরদের এক ধরনের রূপান্তর ঘটছে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী উদ্ভাবনী সেবা দিয়ে নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট পুরনোদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে তারা। একই সঙ্গে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নও গুরুত্ব পাচ্ছে অপারেটরদের কাছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অপারেটররা প্রযুক্তি সেবার সমন্বয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করছে। তবে বাংলাদেশে চিত্র ভিন্ন। বরং সেবার মান বহুমুখিতার ঘাটতিতে শীর্ষ তিন সেলফোন অপারেটরের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে এসেছেএমন মত বিশ্লেষকদের।

গ্রাহক সংখ্যা আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও তা অপারেটরদের সার্বিক ব্যবসায় গতি আনছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনেও এমন চিত্রই উঠে এসেছে। করোনা মহামারীতে অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবার প্রবৃদ্ধি হলেও তা আয় কিংবা মুনাফার ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। এক্ষেত্রে সেবার কম মূল্য যেমন রয়েছে, তেমনি অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দায়ী। এছাড়া বিভিন্ন সেবায় বিনিয়োগ করতে চাইলেও নিয়ন্ত্রণের কারণে তা থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে অপারেটরদের। আবার উদ্ভাবনী পণ্য সেবার অভাবেও প্রত্যাশিত আয়ের উৎস তৈরি করতে পারছে না তারা।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে সেলফোন অপারেটরদের সেবার মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ), ইন্টারনেট ডাটা সংযোগ, আইপি লিজড লাইন, ওয়াইম্যাক্স এবং ওভার দ্য টপ (ওটিটি) সেবা। দেশে এক সময় সেলফোন অপারেটর লাইসেন্সের আওতায় ডাটাভিত্তিক বিভিন্ন সেবা দেয়ার সুযোগ থাকলেও তা পরবর্তী সময়ে বন্ধ করা হয়েছে। এখন আলাদা লাইসেন্সের আওতায় এসব সেবা পরিচালিত হচ্ছে।

অপারেটরদের সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায় বহুমুখী করতে ডিজিটাল নানা সেবা নিয়ে এসেছে অপারেটররা। এর আগে -কমার্স মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মতো আরো বেশকিছু সেবা চালুর আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাতে অনুমোদন দেয়া হয়নি। অন্যদিকে অবকাঠামোয় তাদের নিয়ন্ত্রণ আগের চেয়ে কমেছে।

নিয়ন্ত্রণের কারণে অপারেটরদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না বলে মনে করেন ডাক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, অপারেটররা তাদের মূল সেবার মানোন্নয়নেই পিছিয়ে রয়েছে। গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগই করছে না তারা। ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য আগে এটি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা অপারেটরদের বিভিন্ন ছাড় দিয়ে চলেছে।

শীর্ষ সেলফোন অপারেটর বিটুবি প্লাটফর্ম হিসেবে সেলবাজার চালু করেছিল। গ্রামীণফোনের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক টেলিনরের কাছে এটির মালিকানা হস্তান্তরের পর এখানেই ডটকম নামে কার্যক্রম পরিচালিত হয় এটির। পরবর্তী সময়ে তা বন্ধও হয়ে যায়। এখন জিপি অনলাইন শপে হ্যান্ডসেটসহ অন্যান্য সেবা বিক্রি করছে গ্রামীণফোন। একই ধরনের সেবা রয়েছে রবিরও। এদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া একাধিক ওয়াইম্যাক্স অপারেটরের সঙ্গে যৌথভাবে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা চালুর আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে গ্রামীণফোনের ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে খাতে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ৮২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময় ছিল ৮৫০ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে হাজার ৬২১ কোটি টাকা আয় করেছে গ্রামীণফোন লিমিটেড, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক শতাংশ বেশি।

গ্রামীণফোন লিমিটেডের সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, ভবিষ্যতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গত কয়েক বছর ধরে গ্রামীণফোন রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। যার মাধ্যমে নিয়মিত পরিবর্তন হতে থাকা গ্রাহকের চাহিদা মেটানো সহজ হবে। কভিডের প্রভাবে গ্রাহকদের সেবা ব্যবহারের ধরনে পরিবর্তন এসেছে, যা আমরা মূল্যায়নের মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সেবার মানোন্নয়ন অব্যাহত রেখেছি। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে আমরা ডিজিটালাইজড সেবাও দিচ্ছি, এক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী অ্যাপ চালু করেছি। যেখানে নিত্যনতুন ফিচারও যুক্ত করেছি। তবে এখনো অনেক গ্রাহক আছেন যারা ডিজিটাল জগতের অংশ হননি, যা মাথায় রেখে আমাদের ফ্ল্যাগশিপ রিটেইল স্টোর সম্প্রসারণ করেছি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। আমরা অ্যাডভান্স নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছি।

দেশের পুঁজিবাজারে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর শেয়ার লেনদেন শুরু হয় দ্বিতীয় শীর্ষ সেলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার। মূল প্রতিষ্ঠান আজিয়াটার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে আগের বছরের তুলনায় রবির আয় বেড়েছে দশমিক শতাংশ। তবে সময়ে গ্রাহকপ্রতি আয় (এআরপিইউ) কমেছে প্রতিষ্ঠানটির। ২০১৯ সালে রবির গ্রাহকপ্রতি আয় ছিল ১২১ টাকা, যা গত বছর কমে দাঁড়ায় ১১৭ টাকায়।

আয় গ্রাহক সংখ্যা বিবেচনায় দেশের তৃতীয় সেলফোন অপারেটর বাংলালিংকের প্রবৃদ্ধিও একই ধারায় রয়েছে। বাংলালিংকের মূল প্রতিষ্ঠান ভিয়নের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারিজুন) বাংলালিংকের আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক শতাংশ বেড়েছে। তবে সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সুদ, কর, অবচয় অবলোপন পূর্ববর্তী মুনাফা (ইবিআইটিডিএ) দশমিক শতাংশ কমেছে।

গ্রামীণফোন, রবি বাংলালিংক ফোরজি-এলটিই মোবাইল ফোন সার্ভিসেস অপারেটর লাইসেন্স পেয়েছে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত লাইসেন্সের মেয়াদ থাকছে। সেবাদানের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তি নিরপেক্ষ তরঙ্গের বেতারযন্ত্র ব্যবহারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ পায় গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি এয়ারটেল। পরবর্তী সময়ে একই বছরের অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে সেবা চালু করে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটক পরীক্ষামূলকভাবে থ্রিজি সেবাদান শুরু করে আরো এক বছর আগে। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর সেবাটি চালু করে টেলিটক। থ্রিজি চালু হওয়ার পর থেকে ডাটাভিত্তিক সেবায় কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সেলফোন অপারেটররা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহক সংখ্যা আয়ের ভিত্তিতে সেলফোন সেবা খাতের নিয়ন্ত্রণ মূলত তিন সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক রবির নিয়ন্ত্রণে। একীভূতকরণের পর রবির নিয়ন্ত্রণ আরো বেড়েছে খাতটিতে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সবচেয়ে পুরনো সেলফোন অপারেটর সিটিসেলের কার্যক্রম। ফলে শীর্ষ তিন অপারেটরের বাইরে রয়েছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, আগস্ট শেষে দেশে সেলফোন সংযোগ সংখ্যা ১৭ কোটি ৮৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের সংযোগ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার, রবি আজিয়াটার কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার বাংলালিংকের কোটি ৬৯ লাখ। আর রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র সেলফোন অপারেটর টেলিটকের সংযোগ সংখ্যা ৬২ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা বাজারের ৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ গ্রামীণফোনের দখলে। রবির দখলে রয়েছে বাজারের ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর বাজারের ২০ দশমিক ৬৬ শতাংশ দখলে রেখেছে বাংলালিংক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন