বগুড়ার আলী সাহেব বুকে ব্যথা নিয়ে সম্প্রতি রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলেন। সিটি স্ক্যান করে দেখা যায়, তার বুকে তেলাপোকার ছবি। ডাক্তার তাকে বুকে অপারেশনের পরামর্শ দেন। ধনী এ ভদ্রলোক উন্নত চিকিৎসার জন্য চেন্নাইয়ে যান। সেখানে তার বুকের এক্স-রে করলে বলা হয়, তেলাপোকা তার বুকে না, তেলাপোকা আছে এক্স-রে মেশিনে। সব মিলিয়ে আলী সাহেবের খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা নওশাদ বুকে ব্যথা অনুভব করার পর প্রতিবেশীর পরামর্শে চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গেলেন। সেখানে ইসিজি, ইকো, এক্স-রে, ইটিটি পরীক্ষার পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিমাপ করে জানা যায়, তার হূদরোগ নেই। গ্যাস্ট্রিকের কারণে তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। হূদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা নিতে বলেন। তিনি আরো জানান, রোগী এর চিকিৎসা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেই নিতে পারতেন।
নওশাদ গ্রামে একটি ছোট্ট মুদি দোকান চালান। ওই দোকানের আয় দিয়ে তাদের ছয়জনের সংসার চলে। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসার সময় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে তিনি ১০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। ঢাকায় আসা-যাওয়া ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে সে টাকার পুরোটাই খরচ হয়েছে। অথচ সঠিক পরামর্শ পেলে তিনি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই চিকিৎসা নিতে পারতেন। কিন্তু তা না পাওয়ায় তাকে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।
এভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। রোগের প্রাথমিক পরামর্শের জন্য রোগী কোথায় যাবেন, কোন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেবেন, কতটুকু অসুস্থ হলে কোন পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন—স্বাস্থ্য বিভাগের এ-সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইন নেই। এ অবস্থায় রোগী নিজের সিদ্ধান্তেই বড় হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী ভুল করে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞের কাছে যান।
এভাবে বড় হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগী অযথাই ভিড় করছেন। রোগীর যেমন মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক অপচয় ঘটছে, তেমনি ঘটছে চিকিৎসকের মেধার। এ অবস্থা নিরসনে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে বারবার উদ্যোগ নেয়ার পরও দীর্ঘদিনেও এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হয়নি। কেন এ পদ্ধতি চালু করা যাচ্ছে না, অনেকে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ কারণে আলোচনা হলেও বিষয়টি আর তেমন এগোচ্ছে না।
বাংলাদেশে রেফারেল সিস্টেম চালু না থাকায় যে রোগীর মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা, তিনি যাচ্ছেন হূদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে; কিডনি রোগী যাচ্ছেন মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে। এতে রোগীর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, সময় নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে অপ্রয়োজনীয় ভিড় বাড়ছে। প্রকৃত রোগীর স্বাস্থ্যসেবা হচ্ছে বিলম্বিত।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য সরাসরি ঢাকায় চলে আসছেন। অথচ প্রথমে তার কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। সেখানকার নির্দেশনা অনুযায়ী যাওয়ার কথা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগ ও সবশেষে টারশিয়ারি এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসার কথা। কিন্তু রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকায় রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজস্ব সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। এতে রোগীর আর্থিক অপচয়, সময় নষ্ট ও ভোগান্তি হয়। আবার যে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে রোগী যান, তাদেরও সময়ের অপচয় হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন যাদের চেম্বারে প্রতিদিন ২০০-৩০০ রোগী দেখতে হয়। এতে তিনি রোগীকে সময় নিয়ে দেখতে পারেন না। রেফারেল পদ্ধতিতে রোগী সরাসরি টারশিয়ারি হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গেলে জনগণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত সম্ভব হবে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো রেফারেল পদ্ধতি না থাকায় উন্নত চিকিৎসার আশায় রোগীরা ঢাকায় এসে ভিড় জমাচ্ছে। ফলে ইমার্জেন্সি, আউটডোর ও ইনডোরে ভিড় বাড়ছে এবং কখনো কখনো হাসপাতালের শয্যা খালি না থাকলেও রোগীকে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্টদের বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। এমন ভিড় না থাকলে হয়তো আরো উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত সম্ভব হতো। কার্যকর রেফারেল পদ্ধতিতে একজন সাধারণ চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান, একজন বিশেষজ্ঞ অন্য বিশেষজ্ঞের কাছেও রোগী পাঠান। এমনকি এক হাসপাতাল অন্য হাসপাতালেও রোগী পাঠায়। এ পদ্ধতি চালু হলে ঢাকাসহ বড় হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বারে রোগী আসার পরিমাণ কমবে। দরিদ্র রোগীদের আর্থিক সাশ্রয় হবে। তবে তার আগে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ফোকাল পয়েন্ট বা দায়িত্ববান ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করে রেফারেল ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে। কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি রোগী ও চিকিৎসক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা করে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো ও চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করা খুব জরুরি।
ডা. মো. শফিউর রহমান: বিভাগীয় প্রধান, পেশা ও পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগ
নিপসম, মহাখালী, ঢাকা