গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে শ্লথগতি

কার্যক্রমে গতি আনতে ব্যবস্থা নিক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ

গ্রাম উন্নয়নে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এর জন্য একাধিক কর্মসূচিও নেয়া হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনে তৃতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয় সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি এর আগে দুই পর্যায়ের সফলতার পর তৃতীয় ধাপে প্রকল্পটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলোচ্য কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত সময় ডিসেম্বর হলেও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৩ শতাংশ। প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যও অর্জন হয়নি। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসূচিটি দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। একই সঙ্গে যেসব কারণে কর্মসূচিটির বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে দ্রুত তার সমাধানও করা প্রয়োজন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের গ্রাম উন্নয়নে বিভিন্ন মডেল অনুসৃত হয়। যেমন কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন মডেল, বগুড়া উন্নয়ন মডেল। বিভিন্ন দাতা সংস্থা এনজিও মডেলে গ্রাম উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন অত্যন্ত ধীর। এর কিছু কারণ বিদ্যমান, যা হলো সামগ্রিক নেতৃত্ব সততার অভাব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কর্তব্য কাজে অবহেলা এবং সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব। গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে ভি-এআইডি (ভিলেজ এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট) কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৯৫৯ সালে কুমিল্লায় বিএআরডি (বার্ড) প্রতিষ্ঠা, যা কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত বার্ড, স্বনির্ভর আন্দোলন, উলশী-যদুনাথপুর প্রকল্প, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, বাঁচতে শেখা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কাজ করে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিও একই পরিণতি লাভ করুক, তা কারো কাম্য নয়। কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগের আওতাধীন চার সংস্থাকুমিল্লার বার্ড, বগুড়ার আরডিএ, বিআরডিবি সমবায় অধিদপ্তর। অস্বীকারের উপায় নেই, পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ অদক্ষতা উদাসীনতা, যা কাম্য নয়। কেননা একই সময়ে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ অনেক কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। করোনার মধ্যেই বিপুলসংখ্যক গৃহহীনকে ঘর দেয়া হয়েছে। শুধু তা- নয়, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পও সঠিকভাবে চলেছে। অবশিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের আরো কর্মতত্পর হতে হবে। দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশ। অর্জন ধরে রাখতে হলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নেয়া প্রতিটি কর্মসূচি সঠিক সময়ে শেষ করা প্রয়োজন। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্যও এটি জরুরি।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ফিলিপাইনের সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে মহামারী চলাকালীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সাহায্য আর স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা প্রদান কর্মসূচির সঙ্গে সংযুক্ত করে। একই সঙ্গে তাদের বিভিন্ন কাজে দক্ষ করে গড়ে তুলতে উপার্জনক্ষম করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ৭৬ শতাংশ কঠোর লকডাউনের মধ্যেও নিজেদের উপার্জনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সফল হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে স্থানীয় সরকার সম্প্রদায়গুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। কেননা তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ঘিরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতাকে আরো ভালোভাবে প্রতিফলিত স্থানীয় সমস্যাগুলো ভালোভাবে চিহ্নিত করে। প্রক্রিয়ায় সুশীল সমাজকে যুক্ত করার মাধ্যমে সরকারকে আরো গঠনমূলক জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার পাশাপাশি অধিক কার্যকর কর্মসূচি নীতি প্রণয়নের বিষয়গুলোয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির প্রভাব বাড়াতে সরকার তার অন্যান্য অংশীজনের অবশ্যই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তারপর প্রয়োজন অনুসারে তা সংশোধন করতে হবে।

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, অদক্ষতা নয়, প্রকল্প চলাকালীন অধিকাংশ সময়ই করোনার বিস্তৃতি থাকায় এর প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। একথা সত্য, করোনার কারণে প্রশিক্ষণধর্মী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যান্য কর্মসূচি কেন বাস্তবায়ন করা গেল না, তার সদুত্তর মিলছে না। করোনার প্রকোপ এখন কমে এসেছে। প্রত্যাশা থাকবে, বর্ধিত সময়ের মধ্যে কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন হবে। শুধু অর্থ ব্যয় নয়, প্রকল্পের গুণগত মান যেন বজায় থাকে, সেজন্য তদারকিও জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি টাইমফ্রেম তৈরি এবং সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা, তা যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আরডিএ, বার্ড, বিআরডিবির কাজের ক্ষেত্রে আলাদা সুনাম রয়েছে। এর মধ্যে কাজের জন্য সংস্থাগুলো বেশকিছু পুরস্কারও অর্জন করেছে। কারো উদাসীনতার কারণে তাদের অর্জিত সুনাম ক্ষুণ্ন হোক, তা কেউ প্রত্যাশা করে না। আমরা চাইব বর্ধিত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করা হবে। শুধু অর্থ ব্যয় নয়, প্রকল্প থেকে ইতিবাচক ফলও নিশ্চিত করতে হবে। 

সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগ: . একটি বাড়ি একটি খামার পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, . আশ্রয়ণ প্রকল্প, . ডিজিটাল বাংলাদেশ, . শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, . নারীর ক্ষমতায়ন, . ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, . কমিউনিটি ক্লিনিক মানসিক স্বাস্থ্য, . সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, . বিনিয়োগ বিকাশ এবং ১০. পরিবেশের সুরক্ষা। উদ্যোগগুলোর প্রতিটিই প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য অসমতা হ্রাসের সঙ্গে জড়িত। একটি সফল না হলে অন্যগুলো থেকে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। কারণে অন্যান্য প্রকল্প সফল করতে তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের আওতাভুক্ত জনগণই গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী। ফলে স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচনে প্রকল্প অনন্যসাধারণ। দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকা কার্যক্রমের সুবিধা পাবে। এতে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য উপার্জন উৎপাদনশীল সম্পদে তাদের প্রাপ্যতা বাড়বে, যা এসডিজি ২০৩০ বাস্তবায়নের সঙ্গেও সম্পর্কিত। এমন একটি প্রকল্পে অদক্ষতা উদাসীনতায় বিলম্বিত হওয়া কাম্য নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন