বহুপক্ষীয় সংস্থা

ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা সংকট

জয়তী ঘোষ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম ঘিরে সমালোচনার হাজারটা কারণ আছে। তবে এবার তারা যে ধরনের বৈধতার সংকটের মুখোমুখি, তার ভিত্তি অবশ্য ভিন্ন; বরং অনেকটাই ভুল কারণে উদ্ভূত হয়েছে এবং ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম দ্বারা জর্জরিত প্রকৃত সমস্যাগুলো সামনে এনেছে। বর্তমান বিতর্কের উৎস বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক ডুয়িং বিজনেস সূচকে চীন সৌদি আরবের অবস্থান উন্নত করার লক্ষ্যে কথিত হেরফেরের কারণ। অভিযোগের আঙুল আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার দিকে, যিনি কথিত অনিয়মের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন।

এরপর অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য উইলমারহেল নামে একটি আইনি সংস্থাকে দায়িত্ব দেয় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু তাদের প্রতিবেদনটিতে তথ্য-প্রমাণের বদলে অনর্থক বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। নোবেলজয়ী একসময় বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জোসেফ স্টিগলিত্জ তার লেখায় বিষয়টি বর্ণনা করেছেন লিখিত আক্রমণ জর্জিয়েভার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে। তাছড়া তদন্তটি এক ধরনের সুবিধাজনক পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে চীনের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। পাশাপাশি সৌদি আরবের র্যাংকিংকে প্রভাবিত করতে তত্কালীন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের ভূমিকার প্রতি কম গুরুত্বারোপ করে। অথচ ২০২০ সালের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে আকস্মিকভাবে সৌদি আরবকে বিশ্বের শীর্ষ সংস্কারক দেশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।

এদিকে উইলমারহেল প্রতিবেদনটি মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকানদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এবং তারা সঙ্গে সঙ্গেই জর্জিয়েভার পদত্যাগ দাবি করে বসেন। কিন্তু তথ্য কারচুপি সম্পর্কে তাদের বর্তমান নৈতিকতাবাদী উচ্ছ্বাস বিষয়টাকে উপেক্ষা করে যে ডুয়িং বিজনেস সূচকযা এখন বন্ধ আছেশুরু থেকেই গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ছিল। যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে এটি বিনিয়োগকারীদের ধারণা এবং নীতিনির্ধারকদের পছন্দের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল।

তাই সমস্যাটি বেশ প্রকট। প্রথমত, সূচকগুলো সরাসরি ওয়াশিংটন কনসেনশাসের মতো গোড়া অর্থনৈতিক নীতি থেকে উদ্ভূত। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অ্যাডাম টুজ যেমন তার বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ডুয়িং বিজনেস সূচক পরিমাপের বিষয়টি সবসময়ই ছিল জটিল বিচারের মাধ্যমে তৈরি একটি বিশৃঙ্খল অনিশ্চিত হিসাব-নিকাশ। -বিষয়ক আমার লেখা একটি নিবন্ধতে আমি তুলে ধরেছি সূচকে সরকারি নিয়মগুলো কীভাবে ব্যয়বহুল অবাঞ্ছিত হিসেবে দেখা হয়েছে। তাছাড়া করকে বিবেচনা করা হয়েছে শুধু এক ধরনের খরচ হিসেবে। করকে প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষিত কর্মী তৈরির ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি, অথচ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যা অত্যন্ত জরুরি।

২০১৮ সালে পল রোমার বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব পালনের সময় বলেছিলেন, ডানপন্থী মতাদর্শ ব্যাংকের পদ্ধতিগত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা একই সঙ্গে দেশগুলোর র্যাংকিংয়েও পরিবর্তন আনছে। এজন্য তিনি চিলির বামপন্থী সরকারের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছিলেন র্যাংকিংয়ে দেশটির নিম্নমুখী অবস্থানের কারণে। ডুয়িং বিজনেসের একটি স্বতন্ত্র প্যানেল পর্যালোচনা তুলে ধরে যে সূচকটি প্রকৃত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধু তাদের পূর্বনির্ধারিত বিধিসম্মত বিষয়গুলোই তুলে ধরে এবং কখনো কখনো এমন সব ব্যবসায়িক নীতির প্রশংসা করে, যার ফলে সামাজিকভাবে যার চরম মূল্য দিতে হয়।  

মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বোর্ডের বার্ষিক সভায় জর্জিয়েভার ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তিনি যদি তার পদে বহালও থাকেন তাহলেও ডুয়িং বিজনেস বিতর্কের কারণে তার প্রভাব মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (এটাই হয়তো মূল লক্ষ্য ছিল) আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, ঘটনা দিয়ে ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সমস্যাগুলো হালকা করা যাবে না। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া ক্ষমতা; সমর্থনপ্রত্যাশী দেশগুলোর প্রতি আইএমএফের আরোপিত শর্ত; যা এর মূলনীতির বিরোধী। এছাড়া বহুমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় সক্ষম করতে জি৭ দেশগুলোর অনাগ্রহ।

জন মেনার্ড কেইনস চেয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে। কিন্তু ১৯৪৪ সালে যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা কেইনসের প্রত্যাশাগুলো খুব একটা আমলে নেয়নি; বরং প্রতিষ্ঠানটিতে সে সময়ের ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে তাদের ভোটাধিকার কোটা নিশ্চিত করে, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে; যাতে তারা আইএমএফের নীতি, কর্মসূচি অর্থ বরাদ্দকে প্রভাবিত করতে পারে।

এর পর থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ শক্তি কাঠামো মূলত অপরিবর্তিত রয়েছে। এমনটি ২০১৬ সালের পুনর্বরাদ্দের পরও আমেরিকা তাদের ১৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোটিং শেয়ার অটুট রাখে, যদিও ওইসিডি তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মোট শেয়ারের পরিমাণ ৬০ শতাংশ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি কোটা বরাদ্দের বিষয়টি রুখে দেয়, কারণ তাদের শঙ্কা ছিল এটি যদি তারা প্রতিহত না করে, তবে তা চীনের শেয়ার বাড়িয়ে দেবে। তাছাড়া আইএমএফের যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। উপরন্তু, আইএমএফের জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্টস অনুসারে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কে হবেনতা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত করা হয় আর আইএমএফের প্রধান নিয়োগ করা হয় ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্য থেকে।

আমি মনে করি, আইএমএফের সবচেয়ে বাজে দিকটা হচ্ছে তারা যে পদ্ধতিতে কার্যক্রমগুলো পরিচালিত করে সে-সম্পর্কিত। তহবিল থেকে তারা বিভিন্ন দেশে যে অপর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ করে, তা শুধু ব্যালান্স অব পেমেন্টস সমস্যায় আক্রান্ত নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের কঠিন শর্তে ভরা। যার মধ্যে অন্যতম তহবিল কর্তনবেশির ভাগ দেশই এগুলো এড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকে। এগুলো ছাড়াও আইএমএফ ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর জন্য সুদহার আরো বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের থেকে ঋণ গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও জুড়ে দেয়। যা ওই দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য লাভের বদলে অনেকটাই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

আইএমএফের আর্থিক কঠোরতা আরোপের বিষয়গুলো অনেক বেশি সমালোচিত, এমনকি সংস্থাটির নিজস্ব অর্থনীতিবিদরাও সে সমালোচনায় শামিল হয়েছেন। তাছাড়া আর্থিক কঠোরতা আরোপের বিষয়টি তারা কভিড-১৯-এর সংকটের সময়ও শিথিল করেনি। যে কারণে আইএমএফ প্রতিষ্ঠিত হয়, বিদ্যমান বিষয়গুলো তার বিরোধিতা করে। যদিও আইএমএফ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল সংকটে থাকা দেশগুলোকে ঋণ দেয়া; যার মাধ্যমে তারা তাদের জনগণের কম ক্ষতিসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে।

অথচ জর্জিয়েভার কৃতিত্ব হচ্ছে, বিশেষ অধিকারবলে (তহবিলের রিজার্ভ সম্পদ থেকে) ৬৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের মাধ্যমে আইএমএফের শর্তহীন অর্থায়ন বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তাছাড়া তিনি পুনরুদ্ধার প্যাকেজগুলোয় কম কঠোরতা আরোপসহ আন্তর্জাতিক ঋণ কাঠামো সংস্কারের আহ্বানও জানিয়েছেন। সম্ভবত এসব কারণেই যারা তাকে অপসারণের চেষ্টা করছেন তারা মূলত ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানের যেকোনো ধরনের প্রগতিশীল পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন।

ধরনের প্রচেষ্টা শুধু অন্যায় নয়, সংকীর্ণ মানসিকতারও পরিচয়। আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যদি বিশ্বের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে না পারে কিংবা কভিড-১৯ মহামারী জলবায়ু সংকটের সমাধান করতে না পারে তাহলে সংস্থাটি কোনোভাবেই আর তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের দায়িত্বের জায়গা থেকে জি৭ এরই মধ্যে নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণিত করেছে এবং এর নেতারা উদ্ভূত বৃহৎ আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের সংহতি নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা হয়তো এটা ভেবে অবাক হবেন যে (বর্তমানের) ধনী দেশগুলোর নেতারা কেন নিজেদের পা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে গেলেন।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

জয়তী ঘোষ: ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট ট্যাক্সেশনের সদস্য

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন