শস্য বৈচিত্র্য

পুষ্টি নিশ্চিত ও কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে গম চাষ

ড. মো. রুহুল আমীন

বিশ্বব্যাপী মানুষের দানাদার খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে ভাতের পরেই গমের স্থান। আমাদের এই ভাতে-মাছে বাঙালির দেশেও মানুষের মোট দানাদার খাদ্য চাহিদায় গম দ্বিতীয় অবস্থানে। আবহমানকাল থেকে ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য হলেও সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে গমের আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি খাদ্যের বিস্তৃতি ঘটছে এবং গমের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি ১০০ গ্রাম গম থেকে ৩২৭ কিলোক্যালরি শক্তির জোগান হয়। দানাদার শস্যে শতকরা ১৩ ভাগ পানি, ৭১ ভাগ শর্করা, ১২ দশমিক ভাগ আমিষ এবং দশমিক ভাগ চর্বি বিদ্যমান। এছাড়া গমে ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস এবং নায়াসিন নামের খনিজ ভিটামিন বি থাকে। গমে বিদ্যমান আমিষের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ গ্লুটিন হওয়ায় আটা বা ময়দা নমনীয় এবং প্রসারণযোগ্য। গমের ভুসি উত্তম পশুখাদ্য। গমের ভুসি চোলাইকরণের মাধ্যমে উন্নত মানের আমিষের উৎস হিসেবে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।  

বিশ্বে গম উৎপাদনকারী প্রধান দেশগুলো হলো চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, ইউক্রেন জার্মানি। মোট উৎপাদন ফলনের দিক থেকে চীন শীর্ষস্থানীয়। চীনে বার্ষিক ১৩১ দশমিক মিলিয়ন টন গম উৎপাদন হয় এবং প্রতি হেক্টরে ফলন দশমিক টন। কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর আমাদের দেশে লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ হেক্টর জমি থেকে দশমিক শূন্য মিলিয়ন টন গম উৎপাদন হয়। আরো জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে গম চাষের অধীন জমির পরিমাণ শতকরা শূন্য দশমিক ৫৮ ভাগ বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে প্রতি হেক্টরে ফলন বাড়ে শতকরা শূন্য দশমিক ৬৫ ভাগ। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে গমের চাহিদা ছিল দশমিক মিলিয়ন টন আর ২০২০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় দশমিক ৭৫ মিলিয়ন টন। বর্তমানে ২০২১ সালের জন্য চাহিদা ধরা হয়েছে দশমিক মিলিয়ন টন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর দেশে গমের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রতি বছর আমাদের মিলিয়ন টন গম রাশিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।

পলি-দোঁআশ মাটিতে গম উৎপাদন ভালো হয়। বাংলাদেশে রবি মৌসুমের শুকনা ঔজ্জ্বল্য আবহাওয়া গম চাষের উপযোগী। ফসল চাষের ঋতুকালীন কাম্য তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০ থেকে হাজার ৫০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হাজার ২০০ মিলিমিটার এবং দেশের অধিকাংশ এলাকায় বার্ষিক হাজার ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় বার্ষিক হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং দীর্ঘস্থায়ী বর্ষাকাল বাংলাদেশে গম চাষের প্রধান অন্তরায়। তদুপরি আমাদের দেশের রাজশাহী রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ সারা দেশেই গম চাষ হচ্ছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী উচ্চফলনশীল গমের জাত সৃষ্টির জন্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে দিনাজপুর জেলার নশিপুরে স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ গম ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউট থেকে এরই মধ্যে ডব্লিউএমআরআই গম , ডব্লিউএমআরআই গম এবং ডব্লিউএমআরআই গম নামে তিনটি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। জাতগুলোর হেক্টরপ্রতি ফলন দশমিক থেকে টন। ডব্লিউএমআরআই গম একটি আগাম জাত, পাতার দাগ রোগ মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং দেশের লবণাক্ত এলাকা ব্যতীত সব জায়গায় চাষ করা যায়।  ডব্লিউএমআরআই গম জাতটি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এবং তাপমাত্রা সহনশীল হওয়ায় নাবী জাত হিসেবে ডিসেম্বরের থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত বপন করলেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গমের অনিষ্টকারী পোকামাকড় তেমন নেই বললেই চলে। জাব পোকার সংক্রমণ দেখা গেলেও তা অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা অতিক্রম করে না। সুতরাং পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন হয় না।

বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঠিক দিকনির্দেশনায় এবং বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় করোনা অতিমারীর সংকটকালেও দেশ খাদ্য উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমাদের দেশ ভারত পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে ১১৬টি দেশের মধ্যে ৭৬তম স্থান অর্জন করেছে। কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯-২০ সালে মোট দানাদার শস্য উৎপাদন হয় ৩৭ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন টন। তার মধ্যে ধানের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক মিলিয়ন টন। ধান উৎপাদনের মাধ্যমে দেশ এখন দানাদার খাদ্যে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। পর্যাপ্ত ফল, সবজি মাছ চাষ এবং প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের মানুয়ের খাদ্য চাহিদা মেটানো পুষ্টি নিশ্চিতকরণের জোর চেষ্টা চলছে। মান্ধাতা আমলের কৃষিকে ঢেলে সাজিয়ে দেশ বাণিজ্যিক কৃষিতে ধাবিত হচ্ছে।     

বাংলাদেশে বর্তমানে ৭৭ শতাংশ কৃষিজমি ধান চাষের অধীন এবং আউশ, আমন বোরো তিনটি মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। বেশির ভাগ জমিতেই আউশ, আমন বোরো ধান বা আমন বোরো ধান শস্য পর্যায় দেখা যায়। বছরের পর বছর ক্রমাগত ধান চাষ এবং ধানের জমিতে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির গুণগত মান অবনমন হচ্ছে। তাছাড়া ধানের চারা রোপণ ফসল কর্তনের সময় দেশে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং কৃষকের জন্য লাভজনক হয় না। অন্যদিকে গম চাষ করলে সে জমিতে অনায়াসে পাট চাষ করা যায়। গমের সঙ্গে পাট শস্য পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করলে মাটিতে পাটের পাতা পড়ে জৈব উপাদানের সংযোগ ঘটে। সোনালি আঁশ খ্যাত পাটকে গমের সঙ্গে শস্য পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করলে মাটির উর্বরতা সংরক্ষিত হবে এবং পরিবেশ বিপর্যয় কমে আসবে। তাছাড়া গমের সঙ্গে মিশ্র ফসল হিসেবে ছোলা চাষ করলে দেশে ডালের আমদানি হ্রাস পাবে এবং ছোলার শিকড়ে নড়িউল সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে মাটিতে জৈবিক উপায়ে নাইট্রোজেন সংবন্ধন হবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই গমের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের পঞ্চম ধান উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনাম প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে মিলিয়ন টন গম আমদানি করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম উৎপাদনকারী দেশ চীন এখন ভারত অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানি করছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও গমের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৯ সালে বিশ্বে গমের মোট চাহিদা ছিল ৭৩৩ দশমিক মিলিয়ন টন এবং এর চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধিমান। বিশেষত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ অধিক হারে দানাদার খাদ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ায় চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত এবং কৃষিকে লাভজনক বাণিজ্যিকীকরণের জন্য নতুন নতুন ফসল সংযোজন করা হচ্ছে। উন্নত করা হচ্ছে ফসলের গুণগত মান। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং দেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিতে ধানের চেয়ে অধিক পরিমাণে আমিষসমৃদ্ধ দানাদার শস্য গম চাষ উৎসাহিত করা এখন সময়ের দাবি। গম চাষ বিস্তৃত হলে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল পাট চাষের ব্যাপকতা সৃষ্টি হবে। বর্তমানে পাট দেশের কৃষকদের জন্য একটি অন্যতম লাভজনক ফসল। গম চাষে কৃষকদের আগ্রহী করতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী এবং উচ্চফলনশীল অধিকসংখ্যক জাত অবমুক্তকরণ। তাছাড়া কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রণোদনা প্রদান, সঠিক সময়ে গুণগত মানের বীজ সরবরাহ এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদানের মাধ্যমে তাদের উৎসাহী করতে হবে। সরকারের সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করলে দেশে ঈপ্সিত পরিমাণ গম উৎপাদন সম্ভব। গম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছলে দেশে খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে এবং বিদেশে রফতানিতেও নতুন পণ্য যুক্ত হবে।  

 

. মো. রুহুল আমীন: অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন