প্রথমবারের মতো দেশে হচ্ছে পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা

পথচারীবান্ধব ঢাকা গড়তে দ্রুত চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন করা হোক

ঢাকায় একটা বড় জনগোষ্ঠী চলাচল করে পায়ে হেঁটে। কিন্তু শহরের যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো এখনো পথচারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। তথ্য বলছে, রাজধানীতে ফুটপাত আছে ৪০০ কিলোমিটারের মতো। তার মধ্যে ৬০ শতাংশ ফুটপাত ব্যবহার করা গেলেও বাকিটা নানাভাবে সংকুচিত। ফুটপাত নেটওয়ার্কের ক্রমসংকোচনের ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারীরা। ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশই পথচারী বলে বুয়েটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। অবস্থায় রাজধানীর অরক্ষিত পথচারীদের নিরাপদে হাঁটার সুযোগ সৃষ্টিতে পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এর খসড়া প্রণীত হয়েছে। চূড়ান্ত করে দ্রুত আলোচ্য প্রবিধানমালার কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঢাকায় যানজট কমাতে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার। চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ। তবে চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পথচারীরা অনেকটাই উপেক্ষিত। ফলে ঢাকা এখনো পথচারীবান্ধব হাঁটার উপযোগী শহর হয়ে উঠতে পারেনি। এর পেছনে বেশকিছু কারণ বিদ্যমান। রাজধানীর ফুটপাতগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা নেই। অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ফুটপাতের একটি ধারাবাহিক লুপ ব্যবহার করে এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে যাওয়াটা দুষ্কর। আবার ফুটপাতের একটা অংশ বেদখলের শিকার। হকার, ছোট ছোট দোকান, অবৈধভাবে স্তূপীকৃত নির্মাণসামগ্রী, ময়লা-আবর্জনায় ভরা ডাস্টবিন এবং উন্মুক্ত নালাসহ বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত ফুটপাতগুলো। তদুপরি জেব্রা ক্রসিংয়ে রয়েছে নানা সমস্যা। অনেক স্থানে জেব্রা ক্রসিংয়ে সিগন্যাল বাতি সাইন নেই। কোথাও কোথাও সাইন মুছে গেছে। কোনো কোনো জেব্রা ক্রসিংয়ের শুরু বা শেষে গর্ত বিদ্যমান। সেগুলো সমান্তরাল নয়, উঁচু-নিচু। কিছু জায়গায় গাড়িচালক, বিশেষ করে মোটরসাইকেলচালকরা জেব্রা ক্রসিং দখল করে রাখেন। আবার কিছু জনবহুল স্থান যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট ইন্টারসেকশনে স্বচ্ছন্দে পারাপারের জন্য কোনো জেব্রা ক্রসিংই নেই। আছে ফুটওভার ব্রিজের সমস্যাও। বেশির ভাগ  ফুটওভার ব্রিজ বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী, প্রতিবন্ধী, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী নয়। কিছু স্থানে আন্ডারপাস থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা সর্বসাধারণের জন্য চ্যালেঞ্জিং। একে তো নিরাপদ  নয়, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার ভয় থাকে; তার ওপর সেগুলো ধুলো-ময়লায় পূর্ণ। সব মিলিয়ে ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো পায়ে হাঁটার জন্য অনুপযোগী।

বিশ্বের বেশির ভাগ শহরেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয় পথচারীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা স্বাচ্ছন্দ্য। সেজন্য লন্ডনের মতো বড় শহরগুলোয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান বিবেচ্য হচ্ছে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ; পথচারী নয়। ওইসব শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিদ্যমান। তার পরও চালকদের গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়াটা সেখানে একটা নিত্যচিত্র। এটা পথচারীদের অগ্রাধিকার দেয়ারই প্রমাণ। এছাড়া পশ্চিমা উন্নত দেশের শহরগুলোয় জেব্রা ক্রসিং থেকে শুরু করে ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাসহ শহরের যোগাযোগ অবকাঠামো পথচারীদের মাথায় রেখে নির্মিত। যাতে শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধীসহ সবাই নিরাপদ স্বচ্ছন্দে রাস্তা পার হতে পারে; হাঁটতে উৎসাহিত হয়। ওইসব দেশের অভিজ্ঞতা কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গড়ে ওঠে দেশে। ওই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল সড়কে পথচারীদের নিরাপত্তা বিধান। অনেক দেরিতে হলেও অবশেষে দেশে পথচারীদের সুরক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। খসড়া প্রবিধানমালায় সব বয়সের শারীরিক সক্ষমতার পথচারীদের উপযোগী করে ফুটপাত নির্মাণ, সহজে নিরাপদে সড়ক পারাপার, সড়ক পারাপারে গাড়ি নয়, পথচারীদের অগ্রাধিকার, সড়কের যৌথ ব্যবহার, পথচারী নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যবস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে গাড়ি নয়, পথচারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারে পথচারী, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কর্তব্যের মতো বিষয়গুলোও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এটা একটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ বৈকি।

তবে প্রবিধানমালাটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় একে তো প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক অপ্রতুল আবার সেগুলো অনেকাংশে অপ্রশস্তও। কিছু সড়ক তো সরু হতে হতে ফুটপাতের জন্য জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। উপরন্তু, এখানে গড়ে তোলা হয়েছে অনেক অপরিকল্পিত যোগাযোগ অবকাঠামো। এগুলো প্রবিধানমালা বাস্তবায়নের পথে  বাধা। এসব বাধা দূর করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। সরু রাস্তার যৌথ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটি চেষ্টা করতে হবে। কিছু ফুটওভার ব্রিজ-আন্ডারপাসের অবস্থান মানুষের ব্যবহারের জন্য অসুবিধাজনক। ফলে অনেকেই সেগুলো ব্যবহার করতে চায় না। ধরনের অবকাঠামো চিহ্নিত করে যতটা সম্ভব ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে হবে, প্রয়োজনে সেগুলো অপসারণ করতে হবে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পথচারীদের সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে তারা ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। কেবল নির্মাণ করলে হবে না, সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে সেগুলোয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।

শহরের বাসযোগ্যতার অন্যতম নির্ণায়ক হলো হাঁটার উপযোগিতা। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় অবকাঠামোগত উল্লম্ফন হলেও মানুষের হাঁটার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত। শহরের রাস্তায় পথচারীরা অনেকটা অরক্ষিত। প্রেক্ষাপটে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) উদ্যোগে যে পথচারী প্রবিধানমালা হচ্ছে, সেটি একটি সঠিক নির্দেশনার পদক্ষেপ। এর বাস্তবায়ন জরুরি। শুধু ঢাকা নয়, অন্য শহরগুলোর জন্যও ধরনের প্রবিধানমালা দরকার। ট্রাফিক প্রকৌশলী, স্থপতি-পরিকল্পনাবিদ, মেয়র, নীতিনির্ধারক, নগর-নৃতত্ত্ববিদ এবং সর্বোপরি নাগরিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে আমাদের শহরগুলো হাঁটার উপযোগী হয়ে উঠবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন