কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মতপার্থক্যের জেরে পুঁজিবাজারে ছন্দপতন

নিজস্ব প্রতিবেদক

কভিডের প্রাদুর্ভাবের পর পুঁজিবাজারে এর অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। শেয়ারবাজারে চলমান নিম্নমুখিতার পেছনে মতপার্থক্য অনেকাংশেই ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার বিনিয়োগ নিয়ে গত মাস থেকেই বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পোর্টফোলিওর শেয়ারের দর বেড়ে বিনিয়োগের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে গেলে তা সমন্বয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এছাড়াও পুঁজিবাজার বিশেষ তহবিলের অর্থ অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ এবং অদাবীকৃত লভ্যাংশের অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে স্থানান্তর করা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতপার্থক্যের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবে পুঁজিবাজারের সূচক নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত সাত কার্যদিবসে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স হ্রাস পেয়েছে ৩৪৭ পয়েন্ট।

এর আগেও ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গিয়েছে। ২০১০ সালের শেয়ারবাজারে ধসের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে অনেকটা রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর সময়ে সময়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা, একক গ্রাহক ঋণসীমা বিনিয়োগ গণনা পদ্ধতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারীকৃত বিভিন্ন নির্দেশনার প্রভাব পড়তে দেখা গিয়েছে।

যদিও গত বছর কভিডকালে পুঁজিবাজারের জন্য অনেকটা সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি মহামারীর প্রভাবে গত বছরের মার্চে রীতিমতো ধুঁকছিল পুঁজিবাজার। সূচক নেমে এসেছিল হাজার ৬০০ পয়েন্টে। কভিডের সংক্রমণ রুখতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বন্ধ হয়ে পড়েছিল পুঁজিবাজারে লেনদেনও। মে মাসে বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন নিয়োগ করে সরকার। নতুন কমিশনের উদ্যোগে সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে চালু হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন।

ওই সময় লেনদেন চালু হলেও প্রাণ ছিল না পুঁজিবাজারে। ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমে গিয়েছিল দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ। গত বছরের জুলাই থেকে ছন্দ ফিরে পেতে শুরু করে পুঁজিবাজার। বিএসইসির সংস্কারমূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতে নেয়া কিছু কঠোর উদ্যোগের কারণে আস্থা ফিরে পেতে শুরু করে বিনিয়োগকারীরা। সক্রিয় হতে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিশ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারীরাও। বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ে বাজারের অনুকূল নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সহায়ক ভূমিকা নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও।

কভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবেলায় তারল্য প্রবাহ বাড়াতে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার ওপর ঋণ আমানতের সুদহার - শতাংশ হারে নির্ধারণের কারণে রিটার্ন কমে যায় সঞ্চয়কারীদের। এতে বেশি লাভের আশায় অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। তাছাড়া পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রত্যেককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের সুযোগ রেখে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে চলতি বছরের মার্চে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বেশকিছু বিষয়ে দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ প্রদানের সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করা, বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উৎসাহিত করা, বিশেষ তহবিলের অর্থ সুকুক, করপোরেট বন্ড, গ্রিন বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ড স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের ব্যবস্থা করা, ব্যাংকের ইস্যু করা পারপেচুয়াল বা বেমেয়াদি বন্ডকে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দ্রুত লেনদেনের উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে দুই সংস্থার কর্মকর্তারা নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেন। পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকের বিনিয়োগ এবং ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমা গণনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সে সময় কমিশনের কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিছু বিষয় এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছেও। যদিও পুঁজিবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমা গণনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হয় বছরের সেপ্টেম্বরে। নির্ধারিত সীমার বেশি বিনিয়োগ করায় সময় বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংককে জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পুঁজিবাজার বিশেষ তহবিলের অর্থ অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করার কারণে আরো ১২ ব্যাংককে সময় সতর্ক করা হয়। এসব ব্যাংকের বিনিয়োগ চিত্রও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মূলত এরপর থেকেই ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার বিনিয়োগ নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমার ওপরে চলে যাওয়া কিংবা কাছাকাছি অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোকে সমন্বয়ের জন্য মৌখিক নির্দেশনাও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলো তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ সীমা কিছুটা সমন্বয়ও করেছে, যার প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে দরপতন হতে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের বিষয়টি বরাবরই স্পর্শকাতর। ফলে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের বেশ ভালো প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাজারে।

ব্যাংকের বিনিয়োগ ছাড়াও সম্প্রতি অদাবীকৃত লভ্যাংশের অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে স্থানান্তর করা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ব্যাংক হিসাবে থাকা অদাবীকৃত অর্থ অন্য কোথাও স্থানান্তরের সুযোগ নেই। অন্যদিকে বিএসইসির মত হচ্ছে, বিনিয়োগকারী আমানতকারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিনিয়োগকারীর টাকা আর আমানতকারীর টাকা এক জিনিস নয়।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতপার্থক্যের প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। গত সাত কার্যদিবসে ৩৪৭ পয়েন্ট হারিয়েছে সূচক। অবস্থায় পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএসইসি। বৈঠকে পুঁজিবাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যাংকনির্ভরতা কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে নিজেরাই বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তারল্য জোগান দিতে পারে সেদিকে জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সভায় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলের অর্থ দ্রুত বিনিয়োগ, ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের তহবিলের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি, পরিচালন আয়ের বর্ধিত অর্থ পুনর্বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি বিশেষ তহবিল গঠন করে ব্যাংকগুলো যাতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে পরবর্তী সমন্বয় সভায় বিষয়টি বিএসইসির পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

গতকালের সভায় অংশ নেয়া একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, সংশ্লিষ্ট খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কখনো ছাড় দেবে, আবার কখনো কঠোর হবে, এটিই স্বাভাবিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মনে করেছে তখন ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছাড়া দিয়েছে। আবার যখন দেখল যে কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে অনিয়ম করেছে, তখন কঠোর হয়েছে। বিএসইসিও একইভাবে বাজারের স্বার্থে কখনো কঠোর আবার কখনো নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব তারল্য বাড়াতে হবে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে যদি কখনো ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেও নিতে হয়, সেক্ষেত্রেও বাজারে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

বাজারসংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮টি ব্যাংক তহবিল গঠন করেছে। এর মধ্যে কেউই ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থও বিনিয়োগ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো তত্পর হলে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আরো বেশি হতো।

পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক . শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মুনাফা তুলে নিতে কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করছেন। এজন্য সূচকে কিছুটা নিম্নমুখিতা দেখা যাচ্ছে। দ্রুতই পুঁজিবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন