আলোকপাত

ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা প্রসঙ্গে

ড. মইনুল ইসলাম

গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভোলায় আরো তিনটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। রাশিয়ার গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নাকি তিনটি গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের কাজ পরিচালনা করবে। ফলে অদূরভবিষ্যতে ভোলায় আবিষ্কৃত এবং/অথবা উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে নয়টিতে, যেগুলোর সম্মিলিত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আড়াই টিসিএফ গ্যাস পুরো দেশের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে প্রায় আড়াই বছর। বলা হচ্ছে, ভোলা নাকি গ্যাসের ওপর ভাসছে। এর মানে অদূরভবিষ্যতে ওখানে আরো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমান পর্যায়ে দেশে প্রমাণিত উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদের পরিমাণ কমে ১০ টিসিএফে চলে এসেছে। উপরন্তু, উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে, তা দিয়ে দেশের প্রতিদিনের গ্যাসের গড় চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশও মেটানো যাচ্ছে না। ফলে আমাদের গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য এখন ক্রমবর্ধমান হারে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে এলএনজির দামে প্রচণ্ড উল্লম্ফন ঘটে চলেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে এলএনজি আমদানির ব্যয়ভার এখন দেশের আমদানি বিলে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করছে। গত দুই বছরে এলএনজির দাম বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। ফলে এখন দেশের গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে, দেশের শিল্প খাতেও গ্যাস সরবরাহ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। বিশ্বে গত দুই বছরে কয়লার দামও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের খবরটাকে জনগণের জন্য একটা বিরাট সুখবর বলতেই হবে। আমরা যদি এর সুফল হিসেবে গ্যাস কয়লা আমদানি কমাতে পারি তাহলে জ্বালানি খাতের চলমান সংকট অনেকখানি নিরসন হবে। আর যদি দেশের সমুদ্রসীমায় ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি বড়সড় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যায় তাহলে এলএনজি রফতানি করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার জোয়ার সৃষ্টি হয়ে যাবে।

পর্যায়ে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই প্রতিবেশী মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন অব দ্য সি (ইটলস) এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের জন্য ইতিহাস চিরদিন শেখ হাসিনার সরকারকে কৃতিত্ব দিয়ে যাবে। এটা শুধু এই বিশাল সমুদ্রসীমার ওপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনের কৃতিত্ব নয়; বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের একটি বিশাল এলাকার সমুদ্র সম্পদ আহরণের স্বর্ণ সুযোগ উপহার দিয়েছে সমুদ্রবিজয়। বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তন যেখানে মাত্র লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার, সেখানে লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন যে বাংলাদেশের জন্য কত বড় সৌভাগ্য, সেটা দেশবাসী সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে কিনা জানি না (আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুসারে ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ২০২০ সালে যে মানচিত্র জাতিসংঘে পেশ করেছে, সেটা গ্রহণ না করার জন্য ভারত জাতিসংঘে আপত্তি উত্থাপন করে চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আপত্তির বিষয়টি জানার পর সেটার পাল্টা জবাব দিয়ে জাতিসংঘকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে মাসখানেক আগে। বিষয়টি এখন জাতিসংঘের বিবেচনাধীন)

সমুদ্র বিজয়ের সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও সমুদ্র ব্লকগুলোয় তেল-গ্যাস আহরণের জন্য বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানিকে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে ব্লকের ইজারা প্রদানের ব্যাপারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিস্ময়করভাবে থমকে আছে। অথচ বাংলাদেশ মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর আগে প্রায় চার টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রফতানি করছে মিয়ানমার। ভারত গ্যাসের একটা অংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে নিজেদের দেশে আমদানি করার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে রাজি করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়। প্রস্তাবিত ওই চুক্তিতে এমন শর্তও রাখা হয়েছিল যে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ বাংলাদেশ পাবেই, তদুপরি বাংলাদেশের প্রয়োজন হলে ওই গ্যাসের একটা অংশ বাংলাদেশ কিনে নিতে পারবে। জোট সরকারের অন্ধ ভারত বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মারাত্মক ওই ভুল কীভাবে বাংলাদেশের জনগণকে সস্তায় প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে তার একটা  জ্বলজ্বলে নজির হয়েই থাকবে ব্যাপারটা। এখন পাঁচ গুণ দাম দিয়ে এলএনজি আমদানি করে আমরা ওই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছি (ওই প্রস্তাব গ্রহণ করলে বাংলাদেশকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে হতো না)! উপরন্তু, গ্যাস পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতি বছর হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় করত, যা থেকেও আমরা বঞ্চিত হয়েছি।

এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইউ কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য ইজারা দিয়েছিল। দাইউ যথাযথ প্রস্তুতি সরঞ্জাম নিয়ে ওই অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালানোর জন্য কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। মিয়ানমারের যুক্তি ছিল যে ওই অঞ্চলের সমুদ্রসীমার মালিক মিয়ানমার, বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই ওখানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের। ইটলসের রায়ে ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা ২০১২ সালে পেয়ে গেছে বাংলাদেশ কিন্তু গত নয় বছরেও ওখানে এখনো এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি। মিয়ানমার সমুদ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ যে গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে ওই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুদ তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। হয়তো এমন বিলম্বের কারণে কয়েক টিসিএফ গ্যাস থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ!

বাংলাদেশের লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমায় আরো প্রায় ২৩-২৫টি ব্লক ইজারা দেয়ার সুযোগ রয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আহরণের জন্য। কিন্তু গত সাত বছরে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতিই পরিলক্ষিত হয়নি। ব্লকগুলো পাওয়ার জন্য বিভিন্ন শক্তিধর দেশের বহুজাতিক করপোরেশনগুলো পর্দার আড়ালে প্রচণ্ড লবিং চালিয়ে যাচ্ছে বলে শোনা যায়। কিন্তু আমরা চাই দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সঠিক সিদ্ধান্ত। সাত বছরেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারাটা বড়ই রহস্যজনক! অতিসম্প্রতি ভারতের ওএনজিসি সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান কাজ শুরু করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আশায় রইলাম, আরো অন্যান্য দেশের ইজারাদার আমাদের সমুদ্রসীমায় অচিরেই কাজ শুরু করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত সেপ্টেম্বরের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ব্যাপারে মার্কিন বহুজাতিক করপোরেশনগুলোকে বিনিয়োগের জন্য তার অনুরোধ আশা করি বিফলে যাবে না।

আমি নিশ্চিত যে সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান শুরু হলে বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যেই কয়েক টিসিএফ গ্যাস পেয়ে যাবে, তেল পাওয়াও অসম্ভব নয়। তখন আমাদের সাগরের গ্যাস টার্মিনালে এলএনজি কনভারশন প্লান্ট নির্মাণ করে ওই গ্যাস স্থলভাগে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমার দাবি হলো, ভোলার গ্যাস অতিদ্রুত জাতীয় গ্যাস গ্রিডে পৌঁছানোর জন্য সেখানে জরুরি ভিত্তিতে একটি এলএনজি কনভারশন প্লান্ট স্থাপন করা হোক। বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হোক। এর মাধ্যমে পাইপলাইন স্থাপনের চেয়ে অনেক কম খরচে এলএনজি জাহাজে ভরে মহেশখালীতে স্থাপিত দেশের এলএনজি টার্মিনালে পৌঁছানো যাবে। রকম কনভারশন প্লান্ট স্থাপনের খরচও খুব বেশি নয়। এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করার ব্যবস্থা মহেশখালী এলএনজি টার্মিনালে এরই মধ্যে স্থাপন করেছি আমরা। ভোলা থেকে এলএনজি মহেশখালী নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচও বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে যে ফ্রেইট চার্জ বহন করতে হয় তার তুলনায় অনেক কম হবে।

 

. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি; একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন